সুনামগঞ্জে ফসলরক্ষা বাঁধে ফাটল, বোরো ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কৃষকের
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২০, ৮:৫৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না হাওরবাসীর। করোনা আতঙ্কের মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বৈরী আবহাওয়া ও পাহাড়ি ঢল নেমে আসার আতঙ্ক। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় জেলার কোনও কোনও বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, বাঁধে ফাটলের কারণে তলিয়ে যেতে পারে বাম্পার ফলন হওয়া ক্ষেতের পাকা আমন ধান। এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন ফাটলে মাটি ভরাট করে এবং বাঁশ পুঁতে মাটি ভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধগুলো মজবুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসক বলছেন, যেকোনও ধরনের আগাম বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। তবে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে কিছুই করার থাকবে না জানান তিনি।
চলতি বছর জেলার শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, খরচার হাওর, নলুয়া হাওর, চন্দ্রসোনার থাল হাওর, দেখার হাওরসহ ছোট-বড়ো ৫২টি হাওরে ৬৩৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এসব হাওরে রয়েছে ১৩৫টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার। এসব ঝুঁকিপূর্ণ অংশে পাহাড়ি ঢলের পানি আছড়ে পড়ে। নিমেষেই বাঁধ ভেঙে আগাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।
চলতি বোরো মৌসুমে হাওরের ফসল আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এর মধ্যে ৭৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষে ছাড় দেওয়া হয়েছে ৮২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ বছরের জানুয়ারি থেকে বাঁধের কাজ শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে এসে কাজ শেষ হয়। জেলায় মোট ১ হাজার ৬৭৯ কিলোমিটার অস্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ রয়েছে। এ বছর সংস্কার ও মেরামত করা হয়েছে ৬৩৪ কিলোমিটার। বাকি ১ হাজার ৪৫ কিলোমিটার পুরনো বাঁধ দিয়ে আগাম বন্যা ঠেকানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
চলতি বছর হাওরে ১ লাখ ৬১ হাজার ১০৫ হেক্টর এবং হাওরের বাইরে ৫৮ হাজার ১৯৫ হেক্টরসহ মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের কৃষক আবু চাঁন বলেন, ‘হাওরের বাঁধগুলো বৃষ্টিতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোথাও কোথাও দেবে যায়। এজন্য বাঁধ হুমকির মুখে পড়ে।’ বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক হোসেন মিয়া বলেন, ‘প্রতিরাতে বৃষ্টি হওয়ায় বাঁধের মাটি সরে যায়। নদী ও হাওরের পানির চাপ ক্রমশ বাড়ছে। বৃষ্টির কারণে হাওরের পানি জমছে। বাঁধ রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেকোনও মূল্যে ফসল কাটা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত বাঁধগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে।’ মধ্যতাহিরপুর গ্রামের আব্দুল আলী বলেন, ‘এ বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। হাওর জুড়ে হাসছে সোনালি ধান। তবে হঠাৎ সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে ফসল রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’ কৃষকরা জানান, দিনে রোদ, রাতে বৃষ্টি এবং বৈরী আবহওয়ার কারণে ধান কাটা থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত করায় অনেক সমস্যায় পড়ছেন তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘হাওরে অস্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। নির্ধারিত লেভেলের ওপরে পানি হলে বাঁধগুলোর ডিজাইন লেভেল ফেল করে হাওরে পানি ঢুকবে। এজন্য হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারগুলোতে বিশেষ নজদারি করা হচ্ছে। এগুলো মজবুত করার জন্য বাঁশের খুঁটি ও মাটিভর্তি বস্তা বাঁধের দুপাশে দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ৫ হাজার জিও টেক্সটাইলের বস্তা এবং ২০ হাজার সিনথেটিক বস্তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমীর বিশ্বাস বলেন, ‘হাওরে আগাম বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজনের সঙ্গে উপজেলা কমিটির জরুরি সভা করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে নদীর পানি এখনও খুব একটা বাড়েনি। পানি বাড়লে বাঁধ রক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বাঁধে নজরদারির জন্য পাহারাদার নিয়োগ করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বাঁশ, বস্তাসহ বাঁধ রক্ষার সব উপকরণ নিশ্চিত করা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘আগাম বন্যার কবল থেকে হাওরের ফসল রক্ষার জন্য ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রত্যেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে বাঁধ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে বাড়তি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বাঁশের খুটি, বস্তা, চট ও সুতলি দড়ি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আগাম পাহাড়ি ঢল চলে আসামাত্র তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাঁধের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রশাসনের রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, আবাদকৃত জমি থেকে ৮ লাখ ৬২ হাজার ৪৩৩ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হবে। জেলায় বার্ষিক চালের চাহিদা রয়েছে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৪৪৪ মেট্রিক টন।