ফরিদপুরে এখনো ‘চাপা উত্তেজনা ও ক্ষোভ’, বিজিবি টহল চলছে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ৯:৫৪ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় একটি মন্দিরে আগুন এবং সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হলেও এলাকায় উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরে হিন্দু ও মুসলিম– উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘উদ্বেগ ও আতঙ্ক’ বিরাজ করছে।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে বুধবার ফরিদপুরে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে ফরিদপুর সদরসহ মধুখালী উপজেলার বালিয়াকান্দি পঞ্চপল্লীর কাছে ও বাঘাটে বাজার এলাকায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ে টহল পরিচালনা করছে।
স্থানীয় সাংবাদিক শ্রাবণ হাসান জানান, প্রকাশ্যে উত্তেজনা না থাকলেও বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে এক ধরনের ‘চাপা ক্ষোভ’ বিরাজ করছে।
অন্যদিকে, হিন্দুরা আছেন অন্য ধরনের আতঙ্কে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা এবং মুসলিমদের দিক থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে একটি মন্দিরের প্রতিমায় আগুন ও এরপর সন্দেহের জেরে দুজন শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
গতকাল স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার দুই ভাই আশরাফুল খান ও আসাদুল খানের পরিবারের সাথে দেখা করেছেন।
মন্ত্রী আব্দুর রহমান বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, এই ঘটনাটি অবশ্যই পরিকল্পিত। তিনি মনে করেন, সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির জন্য এ ঘটনা ‘পরিকল্পিতভাবে’ ঘটানো হয়েছিল। তবে এই পরিকল্পনা কাদের তরফ থেকে করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলেননি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী।
“এই দুঃখজনক ঘটনার সমবেদনা জানানোর তো আর ভাষা নাই। এটা তো একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডই বলবো,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বলেন মন্ত্রী আব্দুর রহমান।
শুক্রবার দিন পরিস্থিতি কেমন হবে সেটি নিয়ে নানা উদ্বেগ আছে। এজন্য প্রশাসনের দিক থেকেও বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে।
“বিভিন্ন মসজিদ থেকে প্রতিবাদ সমাবেশ হতে পারে। ইসলামী কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামে একটা সংগঠন আছে তারা ডাক দিয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশের,” বলেন স্থানীয় সাংবাদিক শ্রাবণ হাসান।
গত বৃহস্পতিবার মন্দিরে আগুন ও হত্যাকাণ্ডের পর তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছিল। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসায় সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
কিন্তু গত মঙ্গলবার স্থানীয় মুসলিমরা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে। সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে এই বিক্ষোভ আয়োজন করা হয়।
বিক্ষুব্ধ মানুষ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা যাবত সড়কে অবস্থান করে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশের সাথে বিক্ষুব্ধ মানুষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়েছে।
সে ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর থেকে স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে।
“মুসলমানরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকবে কেন? যারা আইন নিজের হাতে তুলে নেবে তাদেরই এ ধরনের ভয়ভীতি থাকার কথা,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মন্ত্রী আব্দুর রহমান।
“এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করাই হবে সকল ধর্মের মানুষের কর্তব্য। সুতরাং এখানে কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয় নাই।”
আবারো এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, সে আশঙ্কা থেকে বৃহস্পতিবার শান্তি সমাবেশ করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানান মন্ত্রী আব্দুর রহমান।
“ইনশাআল্লাহ পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে,” বলেন মি. রহমান।
তিনি মনে করেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার চেষ্টা হতে পারে। সেজন্য তারা সতর্ক আছেন।
‘অবিশ্বাস্য ঘটনা’
নিহতদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ঘটনাটিকে অবিশ্বাস্য হিসেবে বর্ণনা করেন সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান।
“এটা কোনো মানুষ করতে পারে, এ ধরনের নারকীয় ঘটনা, এটা আসলে সকলের কাছে অবিশ্বাস্য। এটা ছোট্ট তুচ্ছ ঘটনা,সে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আমাদের তো এখন নানাভাবে নানা চিন্তার উদ্রেক হচ্ছে,” বুধবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন মন্ত্রী আব্দুর রহমান।
“যদিও সামনে আনা হয়েছে মন্দিরে আগুন, কিন্তু এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মন্ত্রী আব্দুর রহমান।
“এতো অল্প সময়ের মধ্যে হাজার-হাজার মানুষের আগমন এবং ঘরের ভেতরে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোকে কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই তাদেরকে অ্যাটাক করা এবং তাদেরকে মারতে হবে, তাদের জীবননাশ করতে হবে।”
এই ঘটনার আইনগত তদন্ত হবে এবং তদন্ত সাপেক্ষে নির্ণয় করা হবে এর মধ্যে কোনো উসকানি আছে কি না।
“যারা এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কোনো জাত নেই, তাদের কোনো ধর্ম নেই। জড়িতদের শাস্তির বিধান করা হবে।”
হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার স্থানীয় মানুষ যেভাবে সড়ক অবরোধ করেছে এবং পুলিশের সাথে সহিসংতায় জড়িয়েছে সেটিকে ভালোভাবে দেখছে না প্রশাসন।
বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।
“ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেবার চেষ্টা যারা করেছে তাদের মতলব সুবিধাজনক নয়। এটাকে নিয়ে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করার চেষ্টা তাদের,” বলেছেন মন্ত্রী আব্দুর রহমান।
“মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এগুলো তো আছেই। কোনো স্বার্থানেষী মহলের ভিন্ন কোনো পরিকল্পনাও থাকতে পারে।”
মঙ্গলবার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের বিষয়টি আবারো তৎপর করে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেছে সে কথা বলা যাবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কোনো ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে যাতে কোনো ঘাটতি তৈরি না হয় সেজন্য পুলিশের পাশপাশি বিজিবি মোতায়েন রয়েছে।
সড়ক অবোধের পর ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পরিস্থিতি যতদিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসবে ততদিন পর্যন্ত বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় থাকবে।
“কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যাতে এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয়বার অন্য কোন নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোরশেদ আলম।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মন্দিরে সন্ধ্যা বাতি দেয়া হয়েছিলো। এর কিছুক্ষণ পর প্রতিমায় আগুন ও এর জের ধরে কয়েকজনের ওপর হামলা হলে দুজনের মৃত্যু হয়।
তবে নিহতদের আত্মীয় স্বজন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ডুমাইন ইউনিয়নে পঞ্চপল্লী এলাকা সার্বজনীন কালীমন্দির ও এর লাগোয়াই গড়ে উঠেছে পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
মন্দির এলাকার বিবরণ দিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক পান্না বালা গত শনিবার বিবিসিকে জানান যে মন্দিরটি ছোট আকৃতির এবং এর চারদিকে দেয়াল আর উপরে চৌচালা টিন। আর সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকানো।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় স্থানীয়রা তাকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই মন্দিরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর কাজটি করে মালতী মণ্ডল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি প্রদীপ নিয়ে মন্দিরে গিয়েছিলেন।
ওদিকে ওই মন্দির লাগোয়া স্কুলের শৌচাগার নির্মাণের জন্য পাশেই কয়েকদিন ধরে কাজ করছিলেন একদল শ্রমিক, যাদের বাড়িঘর অন্য এলাকায়।
পুরো এলাকাটিতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন এবং আশেপাশে তেমন কোনো মুসলিম বসতি নেই। ফলে সন্ধ্যার পর প্রতিমায় আগুনের খবর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পড়লে সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
অন্যদিকে তখন মন্দিরের পাশের স্কুলে ছিলেন নির্মাণ শ্রমিকরা। সেখানে চার জন নির্মাণ শ্রমিক, একজন রড মিস্ত্রী, একজন শ্রমিক সর্দার এবং আরেকজন নসিমন চালক ছিলেন।
সন্ধ্যার পরপরই প্রতিমায় আগুনের খবর স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে লোকজন জমায়েত করে কাছেই থাকা শ্রমিকদের ধরে নিয়ে মারধর করতে থাকে। এ সময় তারা একটি নসিমন (স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহৃত যানবাহন) পুড়িয়ে দেয়।
এদিকে শুক্রবার রাতেই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, পিটিয়ে মারার ঘটনায় প্রধানত যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাকে আটক করা হয়েছে। তবে তিনি তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি।
যে দুই ভাই মারা গেছেন শুক্রবার তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।