মনু নদ: আশীর্বাদ না অভিশাপ?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মার্চ ২০২০, ৮:০২ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
মৌলভীবাজার জেলার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মনু নদ। প্রকৃতির আশীর্বাদ এই নদ বহুদিনের অবহেলা আর ড্রেজিংয়ের অভাবে দিনে দিনে এলাকার মানুষের কাছে অভিশাপে রূপ নিয়েছে। এক সময় যে নদ দিয়ে জাহাজ চলত সে নদে এখন ৩৫টি চর, ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। বছর বছর বন্যায় প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা, ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় শত থেকে হাজার কোটিতে।
এ দুঃখ ঘোচাতে রাজপথে নেমে আন্দোলন করলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। আসছে বর্ষায় আবারও প্লাবিত হওয়ার আগেই খননের দাবি স্থানীয়দের। নয়তো আবারও তারা আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এদিকে এ বছর মেগা প্ল্যান নিয়েছে পাউবো তবে পূর্বের মতো লাল ফিতায় বন্দি থাকবে নাকি মন্ত্রণালয় প্রকল্প গ্রহণ করবে তা নিয়ে আছে সংশয়।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, মনু একটি আন্তর্জাতিক নদ। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে ১৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদ বাংলাদেশ অংশের ৭৪ কিলোমিটার অংশের পুরটাই মৌলভীবাজার জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে কুশিয়ারা নদীতে। গড়ে ৩০০ মিটার প্রস্থ মনু নদের উভয় পাশের ১৪৮ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধের ৬৭টি স্থানে ৩০ কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। সাপের মতো একে বেঁকে বয়ে চলা এই নদে প্রাকৃতিকভাবে রয়েছে প্রচুর মোড়। অনেক জায়গা ইউটার্ন করে ঘুরে গেছে এমনকি কিছু জায়গায় বাক অনেকটা ভি আকৃতির। ছোট ছোট চরের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আছে বড় আকারের ৩৫টি চর। এক সময়ের ২০ মিটার গভীর মনু নদ বর্তমানে ১০ মিটারেরও কম।
বিগত ২০ বছরের হাইড্রলজিক্যাল ডাটা এনালাইসিস করে দেখ যায়, বর্ষাকালে নদীটিতে প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ ঘনমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ১৫ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। পাহাড়ি নদ হওয়ার কারণে বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহের বিরাট তারতম্য এবং উজানে পাহাড় ও উঁচু ভূমি থাকায় বানের সঙ্গে প্রচুর মাটি, বালি এসে নদীতে পড়ে যার কারণে নদের তলদেশে পলি পড়ে। প্রচুর বাক থাকায় এসব বাকের এক পাশে চর ও অপর পাশে ভাঙন সৃষ্টি হয়। মনু নদের ৯১ শতাংশ ক্যাচমেন্ট এরিয়া উজানে ভারতীয় অংশে হওয়ায় সেখানে বৃষ্টি হলে দ্রুত পানি ৩-৪ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে ফ্ল্যাস ফ্লাড সৃষ্টি হয় আর এর প্রভাবে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়কে প্লাবিত করে।
সর্বশেষ ১৯৮৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামত শুরু করলেও বাজেট স্বল্পতার কারণে তা হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। আবার যা হয়েছে তাও রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়নি আর। সেইসঙ্গে এত দিনের পুরাতন বাঁধ এবং শহররক্ষা বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় পানির চাপ বাড়লেই ভেঙে পড়ে। ভাঙনের এই খেলা মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, রাজনগর ও সদর উপজেলাসহ আশেপাশের প্রতিটি এলাকায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রতিনিয়তই বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছর বছর মৌলভীবাজারের মনু নদের ভাঙনে ক্ষতি হয় শত শত কোটি টাকা। বন্যা বেশি হলে সে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় কয়েক হাজার কোটিতে। অথচ এক বছরের ক্ষতির যে পরিমাণ তা দিয়ে স্থায়ীভাবে মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়া যেত। কিন্তু এ বিষয়ে সব সময় উদাসীন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। বছর বছর এ নিয়ে চাহিদাপত্র বা প্রকল্প প্রস্তাব থেকেছে লাল পিতায় বন্দী।
মৌলভীবাজার চেম্বার্স অ্যান্ড কমার্সের সাবেক পরিচালক ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, প্রতি বছর যে ক্ষতি হয় তার এক দুই বছরের টাকা দিয়ে স্থায়ী সমাধান দেয়া সম্ভব কিন্তু কেন তা হচ্ছে না জানি না। ২০১৮ সালের বন্যায় শুধু পৌরসভার ভেতরের ব্যবসায়ীদের কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রোজার ঈদের আগে টানা ৭/৮ দিন বন্ধ ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র সাইফুর রহমান রোডসহ বেশির ভাগ এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঈদের দিনসহ প্রতিটি দিন কেটেছে আতংকে। শহর রক্ষা বাঁধ শহরের সব চেয়ে উঁচু রাস্তা সাইফুর রহমান রোড থেকে ৫ ফুট উপরে হলেও তা উপচে পানি ঢুকেছে।
জানা যায়, ১৬-১৭ অর্থবছরে মনু নদের স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য ১৪০০ কোটি টাকা চাওয়া হয় কিন্তু তা মিলেনি মন্ত্রণালয়ের অবহেলায়। এরপর ২০১৮ সালে বন্যায় মৌলভীবাজারের শহর প্লাবিত হয় এবং জেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন পানিবন্দি থাকে। সরাসরি এবং বিভিন্নভাবে বন্যার দীর্ঘদিনের প্রভাবে আর্থিক ক্ষতি আনুমানিক হাজার কোটি টাকার উপরে।
সরকারের মন্ত্রী এবং পদস্থ কর্মকর্তারা এলাকা ঘুরে আশ্বাস দেন বরাদ্দ দেয়ার। কিন্তু আশ্বাস এবং হচ্ছে-হবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে নদের খনন কাজ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন মৌলভীবাজারের আহ্বায়ক আ স ম সোহেল জানান, সর্বশেষ ২০১৮ সালের বন্যায় ক্ষতি হয়েছিল হাজার কোটি টাকার উপরে। এর পর পর আমরা আন্দোলনে নামি। পাউবো অফিস ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিই কিন্তু আশ্বাসের মধ্যেই সব সীমাবদ্ধ। মনু আমাদের আশীর্বাদ কিন্তু উদাসীনতায় তা হয়ে গেছে আতঙ্কের অপর নাম।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে তারা সমাধানের পথে হাঁটছে। চলতি বছর আবারও ১ হাজার ২ কোটির টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে যা পাস হয়ে গেলে এই এলাকার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রকল্পটি একনেকে ওঠার অপেক্ষায় আছে। প্রকল্পটি ইতিমধ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে ।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান , বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনর্বাসন, শহরাংশে ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণ, নদী ড্রেজিং, স্থায়ী তীর সংরক্ষণমূলক কাজ অন্তর্ভুক্ত করে মনু নদের ভাঙন হতে মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষায় ১ হাজার ২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে যা বর্তমানে একনেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এ বিষয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন জানান, মনু শুধু দুঃখ নয় জীবনের অংশ। দুঃখ কাটানোর চেষ্টা করছি। মনুর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, নাব্যতা হারিয়ে গেছে , খনন করে গভীরতা বাড়াতে হবে।