বৃদ্ধাশ্রমে শেষরাত্রি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ৭:০১ অপরাহ্ণ
রায়হান আহমদ:
ইশ, শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। পাঁচদিন হয়ে গেলো জ্বর কমার লক্ষণ নেই। বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। এদিকে খবর পাঠিয়েও খোকার খোঁজ নেই। ভেবেছিলাম খোকাকে বলবো আমায় কদিনের জন্য বাসায় নিতে। জ্বর হয়েছে জানিয়ে জরুরী চিঠি পাঠালাম, সাড়া নেই। এলোও না। তবে কি সত্যিই সে আমায় ভুলে গেছে! দুনিয়াটা এতো স্বার্থপর, এতোটাই নীচ! খোকা কি আমায় মন থেকেও নির্বাসন দিয়েছে! আমি মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে সে ঘুমাতে পারতো না। এখন সে ঘুমায় না বুঝি?
এক এক করে প্রায় ৩ বছর গড়িয়ে চললো এই বৃদ্ধাশ্রমে। কয়েদখানায় বন্দির মতো মাঝেমাঝে খুব অসহ্য মনে হয় এই চার দেয়ালের গণ্ডি। এই যে সন্ধ্যা আসার আগমুহূর্তটা এ সময়ে মনটা পাগল পাগল হয়ে উঠে। ইচ্ছে হয় পালিয়ে যাই। কিন্তু পারি না। আহা, কতদিন প্রিয় নাতিটার মুখ দেখা হয়নি। একসাথে দেখিনি সুর্যোদয়। বেলকনির টবে দাদুভাইয়ের সাথে কুঞ্জলতা গাছ লাগিয়ে ছিলাম, ফুল ফুটলো কি-না তাও জানি না। আচ্ছা, খোকার ডান পায়ের ব্যথাটা এখন কেমন! সে ডাক্তারের কাছে নিয়মিত যাচ্ছেতো!
হাউসবয় এসে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলে ভাবনায় ছেদ পড়ে। এশার আজান হয়ে গেছে। দ্রুত ওযু শেষ করে নামাজ পড়লাম। আজ কেন জানি নামাজেও বার বার খোকা আর তার মায়ের কথা খুব মনে পড়েছে। টের পাচ্ছি জ্বর বাড়ছে। নামাজ শেষে জায়নামাজেই চুপচাপ বসে থাকলাম অনেকক্ষণ।
খোকার বয়স যখন তিন তখন তার মা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মা হারা সন্তানকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করলাম। কখনো সামান্য কষ্ট বুঝতে দেইনি। আমিই ছিলাম তার সব। খোকার মতো বাধ্য ছেলেও সবার হয় না। জায়গা-জমি বিক্রি করে ওকে লেখাপড়া করিয়েছি। ও মানুষের মতো মানুষ হবে। আমি ওকে নিয়ে গর্ব করতাম খুব।
এখন খোকা আমার মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। দামি বাড়ি, গাড়ি কী নেই! বিয়ে করেছে ওর পছন্দে। একদিন বাড়িতে এসে বললো, বাবা বিয়ে করেছি। আমি অবাক হলাম না। আগ থেকেই তেমন কিছু আঁচ করেছিলাম। ওর পছন্দের মেয়েটি রূপবতী না হলেও বড়লোকের দুলালী। তাই বিয়ের আগে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি হয়তো। বৌমা ঘরে আসার পর দ্রুত বদলালো সবকিছু। কাজের লোক ছাটাই, খরচপত্রের নিত্য হিসেব, ভুলে কেউ পানির ট্যাপ খোলা রাখলে-চেঁচামেছি। নিজের ঘরে বসে টিভি দেখতাম। খোকা বললো, একা একা বসে থাকবে কেন? সন্ধ্যেটা আমাদের সাথে ড্রয়িংরুমে কাটাও। আমার রুম থেকে টিভিটা চলে গেলো খোকার বেডরুমে। ড্রয়িংরুমে বিশাল সাইজের টিভি। সবকিছু জিবন্ত মনে হয়। সন্ধ্যের পর খোকা ও বৌমা একদিকে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর আমি পাশে বসে টিভি দেখছি! কেমন অসভ্য অসভ্য ব্যাপার। তারপর থেকে সব বাদ দিয়ে অবসরটা কাটতো শুয়ে শুয়ে।
একদিন বৌমা আবিস্কার করলেন শুয়ে থেকে আমার পেট মোটা হয়ে যাচ্ছে, চামড়াও নাকি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে-এতে রোগ ঝুঁকির সম্ভাবনাও প্রবল। খোকাও মাথা নেড়ে সায় দেয়। বসে-শুয়ে থাকলে শরীরে রোগ বাড়বে, পরিশ্রম করতে হবে। ঘাম ঝরাতে হবে। বৌমা আমায় সকালের বাজারের দায়িত্বটা দিয়ে দিলেন। খোকা বললো, দুপুরে ছেলেটাকে কাছের স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে নিয়ে আসলে ব্যয়াম হবে। এতে শরীর ঝরঝরে থাকবে। আমায় নিয়ে তাদের এ উদ্বেগ মায়া বাড়িয়ে দেয়। মনে মনে বলি, আমি সুখী খুব সুখী। বোধহয় সে শব্দগুলো কেউ শোনেনি, নইলে এখন উপহাস করতো।
কদিন পর বুঝলাম, আমার স্বাস্থ্য নিয়ে তারা যতোটুকু উদ্বিগ্ন তার চেয়ে তারা সংসারে কাজের লোকের খরচ বাঁচাতে যথেষ্ট সতর্ক। প্রথম প্রথম বৌমা আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কাজের কথা বললেও কয়েকদিন পর তা আদেশে রূপ নিলো।
বৌমার বাবা তার মেয়ের সুখের জন্য যেদিন তাদের বিশ্বস্ত চাকরটা আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন সেদিন বুঝেছিলাম আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। বৌমা বললেন, এখন আপনাকে আর কাজ করতে হবে না। কদিন আত্মিয় বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। খোকা বললো, কোথায় যাবে বলো, দিয়ে আসবো।
খোকাটার মা মরে যাওয়ার পর স্বজনদের কেউ খোঁজ নেয়নি। অনেকটা অভিমানে কারো সাথে যোগাযোগ রাখিনি। তাছাড়া গত ৩৫বছরের একটা দিনও আমি খোকা ছাড়া থাকিনি। নরম সুরে বললাম, কোথায় যাবো? আমারতো যাবার কোন জায়গা নেই। খোকার কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। আহা, তোমার বৌমা যখন বলছে তখন ঘুরে আসো না কয়েকটা দিন। কোথায় যাবার জায়গা না থাকলে সাগর পাড়ে যাও। হোটেলে থাকো কয়েকটা দিন। ভালো লাগবে।
বৃদ্ধ কাজের লোকটি জানালো, বৌমার বোন সপরিবারে বেড়াতে আসছে। আমার রুমটা তাদের বড্ড দরকার। আমি বুঝলাম ঘুরে আসার জন্য তাদের এতো তাগিদ কেন! দ্রুতই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম। বললাম এখানে ওখানে না ঘুরে বৃদ্ধাশ্রমে যাই। আমার মতো অনেকেই সেখানে আছেন। বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কথা শেষ না হতেই যেনো বৌমা তা লুফে নিলেন। বললেন, এতে ভালোই হবে বাবা। প্রচুর বন্ধু পাবেন। সময়টা খারাপ কাটবে না। খোকা বললো, দাঁড়াও আমার এক বন্ধুর একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। ফোন করে নিয়ম-কানুনটা জেনে নেই। মনে হলো, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ইচ্ছেটাই ছিলো তাদের। শুধু চক্ষু লজ্জায় বলতে পারছিলো না। আমি তা কাটিয়ে দিলাম। ওই দিনই তারা আমায় বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর তোড়জোর শুরু করলে একটুও অবাক হইনি। শুধু দাদুভাইটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। ও আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। খেলার সাথিকে হারাতে চাইছে না। বুদ্ধিমতি বৌমা এক্ষেত্রে তার পুত্রকে আশ্বস্থ করলেন, আমরা প্রতি শুক্রবার বৃদ্ধাশ্রমে দেখতে যাবো। তখন খেলতেও পারবে। দাদুভাইটা মন খারাপ করে চলে গেলে আমি বাড়ি থেকে পা বাড়াই। খোকার হাতে আমার কাপড়ের ব্যাগ। পিছু ফিরে একবার তাকালাম। বেলকনিতে একা একা দাদুভাই দাঁড়িয়ে আছে। অনুভব করলাম চোখ দুটো ভিজে উঠছে। মুছতে চেয়েও আটকে গেলাম। ক-ফোটা চোখের পানিতে অতীতটাকে চিরদিনের জন্য ভাসিয়ে দিয়ে আমি চলে এলাম এই চার দেয়ালের বন্দিত্বে…
জায়নামাজ থেকে উঠে দেখি টেবিলের উপরে রাতের খাবার ঢেকে রাখা। মধ্যরাতে মন খারাপের এই লগ্নে খিদেটা উবে গেছে। জ্বরটাও ক্রমশ বাড়ছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
খোকার কথা খুব মনে পড়ছে আজ। আর আদরের সেই দাদুভাইটা! সে নিশ্চয়ই এখন প্রবল ঘুমে আচ্ছন্ন। বুকের যে পাশে হৃদপিণ্ড, তাতে খুব ব্যথা অনুভব করছি। খোকার মা আগে চলে গিয়ে ভালোই করেছেন। তিনি থাকলে আজ এ দৃশ্য সইতে পারতেন না! আচ্ছা খোকা কি তার মাকেও কাজের লোক বানাতো-আমার মতো! নাকি তখন অন্য রকম হতো সবকিছু, ভাবতে পারি না। কিছুই ভাবতে চাই না। মাথার দুপাশে ভনভন করছে। মনে হচ্ছে রাতটা খুব দীর্ঘ, ভোর হবে না কখনোই।
ফজরের ঠিক আগ- মুহুর্তে বুকের ব্যথাটা আরো বাড়লো। গলা শুকিয়ে আসছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করছি। বিছানার পাশের টেবিল থেকে পানি গ্লাস আনতে চাইলাম। উল্টে পড়ে গেলো। চারদিকে সুনশান নিরবতা। আহারে, আমার একমাত্র পুত্রটা! ওর মুখটা বুঝি আর দেখা হবে না? আজ এইখানে এভাবে মরে পড়ে থাকলে কে মাটি দেবে, দেবেতো!
আমার নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। শরীর নাড়াতে পারছি না। কয়েকবার হাউসবয়কে ডাকলাম, ঠোঁট নড়লো কিন্তু শব্দ হলো না। কোথাও কেউ নেই। কারো সাড়া নেই। অথচ, আমার কিছু কথা ছিলো। কিছু জরুরী কথা ছিলো খোকার সাথে। তা বোধকরি বলা হলো না।
খোকার মা কি তবে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন? স্পষ্ট তার মুখ দেখতে পাচ্ছি। টেবিলের কোনায় বসে তিনি মিটিমিটি হাসছেন। একি, মধুমালা তুমি চলে যাচ্ছো? দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি আসছি। মধুমালা এ জীবন আমি চাইনি কখনো। মায়া-মমতাহীন নতজানু জীবন। স্বার্থপর সংসারে সারা জীবন বোধকরি সং হয়েই ছিলাম। জীবনের শেষ বেলায়ও পরিবারের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। যার শরীরে আমার রক্ত, আমার খোকা হয়তো জানেই না আজকের সকাল থেকে সে শুধু পিতা হয়েই থাকবে কারো পুত্র হবে না আর।
খোকা, ছোটবেলায় তোকে নিয়ে রহিম শেখের লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। বৃদ্ধ বয়সে কেউ মারা গেলে চামড়া ঝুলে যায়, অন্যরকম দেখায়। সেই লাশ দেখে তুই রাতে ঘুমের মধ্যে বার বার চমকে উঠেছিলি। আমায় জড়িয়ে ধরে ছিলি। আমি মাথার চুলে বিলি কেটে ভরসা দিয়েছিলাম। মৃত্যুর পর আমার চেহারা তেমন হতে পারে। কাজ নেই বাবা আমার লাশ দেখার। নইলে ঘুমের ঘোরে ভয়ে কেঁপে উঠলে ভরসা দেবার মতো হাত খুঁজে পাবে না। খোকা, তোর ছেলেটি যেনো মানুষ হয়। প্রকৃত মানুষ। আমার মতো যেনো তোর গন্তব্য বৃদ্ধাশ্রমে না হয়। এমন হলে তুই সইতে পারবি না। বৃদ্ধাশ্রমে খুব ছারপোকা, রাতে ভালো ঘুম হয় না। তুই এমন নির্ঘুম থাকলে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে।
আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। পানির জন্য বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি…