মৌলভীবাজারের ধান কাটা শেষ, ন্যায্যমূল্য নিয়ে সংশয়
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মে ২০২০, ১১:১৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
প্রতি বছর মৌলভীবাজারের হাওরের ধান তোলা নিয়ে চিন্তিত থাকেন কৃষকরা। কখন ভারতের উজান ঢল নেমে হাওরেরে ধান প্লাবিত করে নিয়ে যাবে। চলতি বোরো মৌসুমে প্রকৃতি ছিল অনুকূলে। বন্যা, পাহাড়ি ঢল, শিলাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি কিছুই ছিল না।
তবে নতুন করে চলমান করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে শুধু ছিল শ্রমিক সংকট। সর্বস্তরের মানুষের প্রচেষ্টায় হাওরের নিম্নাঞ্চলের শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। তবে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে সংশয়ে রয়েছে।
সোমবারই কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলছিলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের নানান উদ্যোগের ফলে হাওরের ধান সফলভাবে কর্তন শেষ হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী জুন মাসের মধ্যে সফলভাবে সারা দেশের বোরো ধান শতভাগ কর্তন সম্পন্ন হবে।
এ সময় মন্ত্রী জানান, হাওরে এ বছর চার লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত মোট চার লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। এর ফলে হাওরে মোট আবাদের শতকরা ৯৯ ভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। সারা দেশে আবাদের পরিমাণ ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে, এর মধ্যে কর্তন হয়েছে ১৮ লাখ ১৮ হাজার হেক্টর; যা মোট আবাদের শতকরা ৩৯ ভাগ।
সারা দেশে মোট ১৪টি কৃষি অঞ্চল ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুরে প্রায় ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ৩৬১ জন কৃষিশ্রমিক ধান কাটায় নিয়োজিত আছে।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ চার হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন। পাশাপাশি চলতি আউস মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমি। আউসের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৮ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন।
গত বছর আমন আবাদ হয় এক লাখ ১৫০ হেক্টর জমিতে। যা উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৭০ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন। আসছে আমন মৌসুমে ধানের আবাদ ও উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ না থাকলে জেলায় তিনটি ফসল বোরো, আউস ও আমন মিলে ছয় লাখ ২৩ হাজার ১৩০ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হবে।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী বলেন, ‘জেলার হাওরগুলোর নিম্নাঞ্চলের শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাওরের বাহিরের ৭০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে ৮৫ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। উঁচু জমিতে আস্তে আস্তে ধান কাটলে সমস্যা নাই। এক কথায় এখন আর ধান উত্তোলনে ঝুঁকি নেই। অবশিষ্ট ১৫ ভাগ ধান কয়েক দিনের মধ্যে কাটা শেষ হবে। শ্রমিকের পাশাপাশি ধান কেটেছে ৩৯টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ১২১ রিপার মেশিন।
এর মধ্যে জেলার সাত উপজেলায় সরকারিভাবে বোরো ধান সংগ্রহের প্রস্তুতি চলছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় কৃষকদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন নেওয়া হচ্ছে। পরে তা লটারি করা হবে। অপরদিকে ছয়টি উপজেলা রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো যাছাইবাছাই শেষে লটারি করা হবে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা থেকে কৃষক পর্যায়ে সরকারিভাবে এক হাজার ২০৫ মেট্রিক টন, রাজনগর উপজেলায় এক হাজার ৬৭৪ মেট্রিক টন, কুলাউড়ায় ৮৪৭ মেট্রিক টন, জুড়ীতে ৬৮২ মেট্রিক টন, বড়লেখায় ৫৫৭ মেট্রিক টন, কমলগঞ্জে ৫০৫ মেট্রিক টন ও শ্রীমঙ্গলে এক হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হবে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার দাস বলেন, পৃথকভাবে জেলা থেকে সিদ্ধ ও আতপ মিলে জেলার ৪৫টি মিল থেকে মোট সাত হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত রুসনী অটো রাইস মিল, রাজনগরে রুজিনা ও রহিমা অটো রাইস মিলকে চাল সংগ্রহে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রাজনগর উপজেলার মনু প্রকল্পের ভিতর মেদিনী মহল এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম ও শেখ আহমদ বলেন, তাদের প্রায় ১৩ বিঘা জমির ধান সবার আগে কাটতে পেরেছেন। কিন্তু একজন শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। তার পর নিজের শ্রমসহ রয়েছে সার, বীজ, কীটনাশকের মূল্য। সব মিলিয়ে লাভবান হওয়া যায় না। বেকার বসে থাকতে হয়, তাই প্রতি বছর কৃষি কাজে নামেন।
হাঁকালুকি হাওরের ভুকশিমইল গ্রামের রুমেল আহমদ, বাদে ভুকশিমইল মো. এলাইছ মিয়া ও জাব্দা গ্রামের কৃষক মিন্টু মিয়া বলেন, আগাম বন্যা হতে পারে এমন চিন্তায় রাতে তাদের ঘুম হতো না। তবে এখন আর সমস্যা নাই। বন্যা, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল না থাকায় মাঠের ফসল নিরাপদে ঘরে তুলতে পেরেছেন।
ধানের মূল্য সম্পর্কে হাওর পাড়ের ওই তিনজন কৃষক বলেন, গাজী-১৪ জাতের ধান ৭৫০ টাকা মনে বিক্রি করেছেন। ব্রি-২৮ ও ২৯ ধান ৮৪০ টাকা থেকে ৮৬০ টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধান উৎপাদন কম হয়েছে, যে কারণে ক্রয়-বিক্রয় কম হচ্ছে। গত বছরের অবিক্রিত ধান চলতি মৌসুমে বিক্রি হচ্ছে প্রতি মন এক হাজার ৫০ টাকা মূলে।
এদিকে স্থানীয় কৃষকরা দাবি করছেন, তাঁরা যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পান। পাশাপাশি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহসহ কীটনাশকের মূল্যসহ কৃষিঋণ সহজ শর্তে নামমাত্র সুদে পাওয়ার দাবি করেন।