আত্মহত্যা একটি মারাত্মক ব্যাধি এবং এর প্রতিকার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০২০, ৩:২৮ অপরাহ্ণ
মোঃ শামছুল আলম:
‘আত্মহত্যা’ বা ‘আত্মহনন’ ইংরেজি (Suicide) হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়া বিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে। ডাক্তার বা চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদ জনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যিনি নিজেই নিজের জীবন বা প্রাণ বিনাশ করেন, তিনি – আত্মঘাতক, আত্মঘাতী বা আত্মঘাতিকা, আত্মঘাতিনীরূপে সমাজে পরিচিত হন।
বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ!
নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ।
★আত্মহত্যার কারণ সমুহঃ
আমাদের দেশে আজকাল আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় এবং ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় আত্মহত্যার খবর ফলাও করে প্রচার হচ্ছে । আত্মহত্যার প্রবণতা বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেশি। বখাটেদের উৎপাতের কারণে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, আবার মা-বাবার সামান্য বকুনির কারণেও আত্মহননের মতো ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক বিপর্যয়, মানসিক অশান্তি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গেও জড়িত আছে আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনা।
আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে বা শেয়ার বাজারে বারবার ব্যর্থ হওয়া মানুষ বা তরুণ-যুবারা আত্মহত্যা করছে। এমনকি একটা মোবাইল ফোনের জন্য বাচ্চারাও আত্মহত্যার মত ভয়ানক পথ বেছে নিচ্ছে! এসব আত্মহত্যার পেছনে কাজ করে প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপ। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে তা সহ্য করতে না পেরেই আত্মহননের মধ্য দিয়ে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা মুক্তি খোঁজে!
যখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে সে অসহায় ও ভরসাহীন ভাবে, তখনই সে আত্মহত্যা করে বসে।
সাউথ ওয়েস্ট সিডনি মেন্টাল হেলথ সার্ভিসের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও প্রভাষক ডা. মোহাম্মদ হেলমি আত্মহত্যার জন্য প্রধানত মাদকাসক্তিকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন,
“আমরা এমন অনেককে দেখেছি, যারা চরমভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে এবং প্রচন্ডভাবে মদ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন করে। তাদের মনোজগতের প্রচন্ড অবনতি ঘটে এবং বাস্তব থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে যেকোন কিছু সংঘটিত হতে পারে এবং অনেকেই আত্মহত্যা করে।”
তুলনামূলকভাবে মুসলিম সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা কম।এর কারণ হিসেবে ডা. হিলমি বলেন, মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার কারণেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কম।
★কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে আত্মহত্যাঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা কবীরা গুনাহ। শিরকের পর সবচে বড় গুনাহ। সকল ফিকহবিদ এবং চার মাজহাবেই আত্মহত্যা হারাম। কারণ, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। ধনী-গরীব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতেই হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” [সূরা আল-আনকাবূত, আয়াত : ৫৭]
আর এ মৃত্যু দান করেন একমাত্র তিনিই। তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন-“তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।” [সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৬]
উপরোক্ত আয়াতদুটি থেকে বুঝা যায় মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র আল্লাহর। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটান তাহলে তিনি অনধিকার চর্চাই করবেন। আল্লাহ তা পছন্দ করেন না। ইসলামে তাই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে।
এ কাজ থেকে বিরত থাকতে মহান আল্লাহ বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র আল কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন-
“যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৩০]
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- “আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫]
এ জন্য প্রিয় নবী (সঃ) আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে নানাভাবে বারণ করেছেন এবং মানুষকে সতর্ক করেছেন। যেমন: ছাবিত বিন যিহাক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।” [বুখারী : ৫৭০০]
অপর এক হাদীছে রয়েছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।” [বুখারী : ৫৪৪২]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে। আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।” [সহিহ ইবন হিব্বান]
জুনদুব ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ [বুখারী : ৩২৭৬]
আত্মহত্যা রোধে করণীয়ঃ
মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম কাটে না। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো দিন কাটে সুখে, কখনো কাটে দুঃখে। কখনো আসে সচ্ছলতা। আবার কখনো দেখা দেয় দারিদ্রতা। কখনো থাকে প্রাচুর্য কখনো আবার অভাব-অনটন। কখনো ভোগ করে সুস্থতা কখনো আক্রান্ত হয়ে পড়ে রোগ শোকে। কখনো দেখা দেয় সুদিন, আবার কখনো আসে দুর্ভিক্ষ। কখনো আসে বিজয়, আবার কখনো আসে পরাজয়। কখনো আসে সম্মান আবার কখনো দেখা দেয় লাঞ্ছনা। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমাদের সময়েই হয়ে থাকে, তা নয়। এটা যুগ যুগ ধরে এভাবেই আবর্তিত হয়ে আসছে। আল্লাহ যেমন বলেন-
“তারপর আমি মন্দ অবস্থাকে ভাল অবস্থা দ্বারা বদলে দিয়েছি। অবশেষে তারা প্রাচুর্য লাভ করেছে এবং বলেছে, ‘আমাদের বাপ-দাদাদেরকেও দুর্দশা ও আনন্দ স্পর্শ করেছে।” [সূরা আল-আরাফ, আয়াত ৯৫]
যেহেতু বিপদ-আপদ, কষ্ট-শোক আমাদের নিত্যসঙ্গী তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নির্মূলে প্রথমত দরকার পুরো সমাজ ব্যবস্থায় ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলন। কারণ, মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় হতাশার চরম মুহূর্তে। আর অনুশীলনরত মুসলিমের জীবনে হতাশার কোনো স্থান নেই। আল্লাহ বলেন- “বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা যুমার, আয়াত : ৫৩]
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যাবতীয় ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এবং আল্লাহ যা-ই করেন বান্দার তাতে কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে, সে কখনো নিজের জীবন প্রদীপ নিজেই নিভানোর মত হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সে তো হাজার বিপদেও অবিচল থাকবে এ বিশ্বাসে যে আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অবশ্যই তিনি আমাকে পুরস্কৃত করবেন। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সর্বাবস্থায় দরকার ইসলামী শিক্ষা এবং দৈনন্দিন জীবন ইসলামের বাস্তবানুশীলন।
তারপর আত্মহত্যা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিবারের। এরপর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে। আত্মহত্যার মতো মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক ব্যাধি নিরসনে এদের প্রত্যেকের সাহায্য প্রয়োজন। সমাজে মানুষ যতবেশী নিজেকে আত্তীকরণ করবে সে ততবেশী সমাজমুখী ক্রিয়াকর্মে নিয়োজিত হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শ ও মুল্যবোধ মানুষকে জীবনমুখী করে। জীবনের অর্থ অনুধাবন করতে শেখায়। ফলে, মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অপ্রতুল অর্থের মধ্যে থেকেও সুনিবিড় পারিবারিক বন্ধন ও পারস্পরিক সহমর্মিতা সন্তানের নিজের জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণ পোষণ করতে সাহায্য করে। সে পরিবারের ও সমাজের একজন অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শুরু করে। ফলে, সমাজে তার জীবন অর্থবহ হবে, অর্থহীন হবে না। তাই আত্মহত্যা নয়, আত্মরক্ষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সুস্থ্য সামাজিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি মুশকিলের পিছনে উপশম আছে (সুরা ইনশিরাহ, আয়াতঃ ৫)।
পরিশেষে বলব যখন নিজেকে অসহায় ও আশাহত মনে হয় এবং আত্মহত্যার কুচিন্তা মনে আসে, তখন মনে করতে হবে এমন কুমন্ত্রণাদাতা শয়তানেরই দুরভিসন্ধি । তাই এসব মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে অবশ্যই দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। বিপদে ধৈর্যধারণে অবিচল থেকে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার প্রেরণা তিনিই মানুষকে দান করেছেন। কখনো আত্মহত্যার কথা মনে এলে ফেতনা থেকে নিজকে রক্ষাকল্পে নামাজের মাধ্যমে বিনীতভাবে আল্লাহর দয়া ও সাহায্য কামনা করা উচিত। মুসলিম পরিবার ও সমাজজীবনে আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে সর্বস্তরের নর-নারী ও সন্তানসন্ততির বেঁচে থাকার জন্য ইসলামের বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা। আত্মহত্যার মত ঘৃণ্যকাজের ধারণা থেকে আল্লাহ আমাদের দূরে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক