প্রয়োজন টেকসই সমাধান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৬ অপরাহ্ণ
গত শতাব্দীর শেষ ভাগে দুই পরাশক্তির মধ্য অস্ত্র প্রতিযোগিতা যে ভয়াবহ নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করেছিল, জলবায়ু পরিবর্তন তার চেয়েও বহুমুখী ভয়াবহতার মুখে ঢেলে দিচ্ছে আজকের বিশ্বকে। এ বিষয়টি আমরা আজ নতুন টের পাচ্ছিনা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা বড়ই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছি এবং দিয়ে যাচ্ছি। ফলে এখনকার প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে অনুধাবন করতে পারছি আমরা কি কি সমষ্যার সম্মূখিন হচ্ছি। বাস্তবতা হল আমরা আমাদের দ্বায়িত্ব বিষয়ে এখনও সতর্ক হইনি। আমরা কেন আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে এমন কান্ডজ্ঞানহীন হলাম?
ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার কারণে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রাত্যহিক জীবন প্রবাহ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়তেছে। সে দিকে কয় জনের ভ্রুক্ষেপ রয়েছে। দ্রুব সত্য কথা হল পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলক বেশি হুমকির মুখে। দিন যত গড়াচ্ছে সমষ্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। জলবায় পরিবর্তনের ফলে দেশেল ঋতু চক্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘঠেছে। সময়ে অসময়ে গরম, ঠান্ডা, বন্যা, ঝড়-বৃষ্টি, খরা ইত্যাদি পরিবর্তন দিন দিন আমাদের হাপিয়ে তুলতেছে।
বাংলাদেশের কৃষিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে উত্তরাঞ্চল। এর সাথে বেড়েছে নতুন পোকার সংক্রমণ। এতে ফসল উৎপাদনে খরচ বাড়ছে কৃষকদের। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নোনাপানির অনুপ্রবেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাসমূহ পরিবারগুলোকে আরও বেশি দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তুমি যদি কিশোর হও, তোমার জীবনের প্রায় প্রতিবছরই একটা খবর দেখেছ। দেশের তাপমাত্রা আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। টিভিতে দেখেছ, বনে আগুন লেগেছে। হরিণ আর খরগোশের মতো প্রাণীগুলো প্রাণভয়ে ছুটছে! দেখেছ কোনো কোনো বছর একদমই বৃষ্টি হয়নি। আবার কোনো বছর এত এত বৃষ্টি হয়েছে, সারা দেশ ভেসে গেছে বন্যায়। তোমাদের রাস্তায় পানি জমেছে হাঁটু পরিমাণ। ঝড় এসে উপকূল এলাকার গাছপালা ভেঙেচুরে নিয়ে গেছে। ফসলের খেত আর মাছের ঘের ভেসে গেছে। এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ব্যাপারটা আমাদের জীবনের সঙ্গে একদম জড়িয়ে গেছে।
তোমার বাকি জীবনজুড়েই জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন হবে। অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বলেছেন, পৃথিবী খুব দ্রুত জলবায়ু বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা যদি এখনই কাজ শুরু করি, তাহলে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন সম্ভব হবে। উদ্যোগ নিলে বাঁচানো যাবে মানুষকে।
কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতিই হল আবহাওয়া। বাতাসের উষ্ণতা, আর্দ্রতা, বায়ু চাপ, বায়ুপ্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টির পরিসংখ্যান দিয়ে আবহাওয়ার পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আর কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বহু বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে বলা হয় জলবায়ু।
তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? এমন প্রশ্নে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা অনায়াসে উত্তর দেয় চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যাংকার অথবা ব্যবসায়ী হওয়ার। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার মতো মনমানসিকতা আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে খুব একটা নাড়া দেয় না। আচ্ছা আমরা কি কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছি, আমাদের জীবনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সামনে সীমাবদ্ধতাগুলো কি? আমরা মনে করি এবং বিশ্বাস করি যে সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিষয়টা আমাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর দূষণের মাত্রা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রধান অন্তরায়। আমরা হয়তো খুব একটা চিন্তা করি না যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম একটি কারণ আজকের এই পরিবেশদূষণ।
বর্তমান পৃথিবীর পরিবেশ নিয়ে ভাবনায় যে দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তার একটি জলবায়ু পরিবর্তন অন্যটি বায়ুদূষণ। অনেকের মনে হতে পারে যে আসলে এই দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, এ ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা ত্বরান্বিত করছে। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারাও বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। প্রতিনিয়তই বায়ুমণ্ডলে জটিল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন একে অন্যকে প্রভাবিত করছে। আমরা জানি, পৃথিবীর মতো এমন অন্য একটি বসবাসযোগ্য বায়ুমণ্ডলসম্পন্ন গ্রহ পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তা–ও আমরা আমাদের সাময়িক বিলাসিতা ও সীমাহীন মুনাফা অর্জনের জন্য প্রতিনিয়তই এই বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করছি। ফলে আমাদের জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও দূষণের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। বিশেষ করে শীত মৌসুমে আমাদের দেশে দূষণের ভয়াবহতা তীব্র আকার ধারণ করে। প্রায়ই পথচারী ও শিক্ষার্থীদের দেখা যায়, মুখে মাস্ক লাগিয়ে চলাফেরা করতে। বর্তমানে বায়ুদূষণসহ আমরা সবাই নানা সমস্যায় জর্জরিত। বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন যেন একটি মুদ্রার দুটি পিঠ। বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন একটি অন্যটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। জীবাশ্ম জ্বালানির দহন ও শিল্পকারখানায় নির্গত ধোঁয়া প্রচুর পরিমাণে ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ও ওজন নির্গত করে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নামেও পরিচিত। এসব দূষকের মধ্যে ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনকে শর্ট লাইভ ক্লাইমেট পল্যুশন (SLCPs) বা স্বল্প আয়ুর জলবায়ু দূষক বলা হয়। ক্রমাগত ফসিল ফুয়েল বা পেট্রোলিয়াম জাতীয় জ্বালানি ব্যবহারের ফলে কার্বন ডাই–অক্সাইড আর গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যানবাহনের দহন, ইটের ভাটা, উন্মুক্তভাবে আবর্জনা পোড়ানো কিংবা আন্যান্য উৎস থেকে বায়ুতে এসব গ্রিনহাউস গ্যাস মিশ্রিত হচ্ছে। এই বিষয়গুলো একদিকে যেমন বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা তাপ ধরে রাখে। আবার পৃথিবী তাপ বিকিরণ করে যে ঠান্ডা হবে, তাতেও বাধা দেয় এই গ্রিন হাউজ গ্যাস। ফলে পৃথিবী সময়ের সঙ্গে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাইক্লোন, ধূলিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা ও অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে।
-চলবে
লেখকঃ- সাধারন সম্পাদক- বিশ্বনাথ ডেফোডিল এসোসিয়েশন-ইউকে