ভালোবাসার অবিনশ্বর সফটওয়ারে সেইভ হয়ে আছেন জনতার ইলিয়াস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৭ অপরাহ্ণ
মোঃ সুবের আহমেদঃ
শাহজালাল (র.) এর পুন্যভুমি সিলেট দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসাবে খ্যাত। আলেম-উলামা, রাজনীতিবিদ, আউল-বাউল, সুফি-সাধক, কবি, সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের তীর্থ স্থান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, নৈস্বর্গীক লীলাভুমির এক অপুর্ব নিদর্শন এই সিলেট। যুগে যুগে এ অঞ্চল দেশবাসী ও বিশ্বমানবকে দিয়েছে ভক্তির আদর্শ, তেজো বীর্যের উৎকর্ষ। শুধু এদেশ নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়েও বহিঃ বিশ্বে রয়েছে সিলেটের অতুলনীয় উপমার উজ্জল দৃষ্টান্ত। সেই সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের রামধানা গ্রামে ১৯৬১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন কর্মপ্রান, বাংলাদেশের রাজনীতির দিকপাল, রাজপথ কাঁপানো জাতীয় বীর, সংগ্রামী জননেতা এম. ইলিয়াস আলী। বিশ্বনাথ উপজেলার পাড়া গাঁ রামধানায় দুরন্তপনা করতে করতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। ধুলো-মাটি মেখে সারাদিন পড়ালেখা আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন কিশোর ইলিয়াস। স্কুলের আঙ্গিনায় পা দেওয়ার আগেই ইলিয়াস নিজ বাড়ী পাড়া গাঁয়ের সহপাঠীদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতেন। নিজের জামা-কাপড় বই-খাতা দিয়ে দিতেন অন্যদের। এজন্য তাকে প্রায় সময় মায়ের বকুনিও খেতে হতো। ছোট বেলা থেকে তার প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। তিনি ফুটবল খেলায় ছিলেন বেশ পারদর্শী যার কারণে এলাকার বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতে হতো। মেধাবী ছাত্র, ভালো একজন ফুটবলার এবং সজ্জন একজন মানুষ হিসেবে ইলিয়াস আলী শৈশব কালেই সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বনাথ রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি কৃতিত্বের সাথে উত্তির্ন হয়ে ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবিতেই) তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করেন। আর সেখান থেকেই ছাত্ররাজনীতি শুরু করে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলার রাজনৈতিক গগনে তার উত্তান ছিল আকর্ষণীয়।
আশির দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা বিএনপির দুর্দিনের কান্ডারী ও ওয়ান ইলেভেনের পরীক্ষিত নেতা এম ইলিয়াস আলী ছিলেন স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব-গণতন্ত্র রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরী। ৮১ পরবর্তী বিএনপির দুঃসময়েও তরুণ ছাত্রদল নেতা জিয়া আদর্শের আপোষহীন সৈনিক হিসেবে মাঠে সক্রিয় থেকেছেন ইলিয়াস আলী। আশির দশক পরবর্তী স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে মিছিলের সাহসী মুখ এম ইলিয়াস আলীর পথ চলা ছিল সব সময় স্রোতের প্রতিকূলে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে গড়া সংগঠন বিএনপির দুর্দিনে দুঃসময়ে জীবন বাজী রেখে আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দিয়েছেন তৃনমুল নেতা-কর্মীদের প্রিয় মুখ এম ইলিয়াস আলী। আপোষহীনতা গণতন্ত্র আর জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে ইলিয়াস আলী ছিলেন সবসময় সোচ্চার। যার জ্বলন্ত প্রমাণ তিনি রেখেছেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে টিপাইমুখ বাধ বিরোধী আন্দোলনে।
ইলিয়াস আলী ছিলেন সিলেট জেলার সেই অমর প্রবাহের একটি দ্যুতিময় তরঙ্গ। কিংবদন্তী ঈর্ষন্বীয় এই জননেতা গুম হওয়ার পুর্ব পর্যন্ত ছিলেন সিলেটের রাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আলোকপাত করলে দেখা যায় তিনি ছিলেন স্বমহিমায় ভাস্বর একজন মহানায়ক। তিনি বৃহত্তর সিলেটবাসীর জন্য আবির্ভুত হয়েছিলেন একজন অভিভাবক হিসেবে। অবহেলিত আর বঞ্চিত এই জনপদের মানুষের জন্য তিনি ছিলেন বট বৃক্ষের ন্যায়।
বিশেষ করে ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় আসন সিলেট-২ বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর অভূতপূর্ব অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই দুই উপজেলাকে করে ছিলেন উন্নয়নের রোল মডেল। যা আজও এই দুই উপজেলা বর্তমানে তিনটি ওসমানীনগরসহ প্রত্যেকটি এলাকায় ইলিয়াস আলীর নাম ফলক গুলো তারই স্বাক্ষী বহন করে আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে যখন সিলেটের ন্যায় সমগ্র দেশবাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখনই পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দোসর এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে গুম নামক আয়না ঘরে বন্দি হয়ে যান বৃহত্তর সিলেটের অবিসংবাদিত নেতা আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক জননেতা এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ী চালক আনছার আলী।
ইলিয়াস আলী আর কোন সভা, সমাবেশে সিংহ পুরুষের ন্যায় গর্জে উঠবেন না? তা কখনো হতে পারে না। তা কখনো মেনে নেয়ার নয়? বিশাল মন-মানসিকতার অধিকারী ইলিয়াস আলী শুধু একজন রাজনীতিবিদ নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অমর হয়ে থাকা এক কিংবদন্তীর ইতিহাস।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা কিংবা প্রতিযোগিতা থাকতে পারে কিন্তু প্রতিহিংসা অবশ্য শুভনীয় নয়। যারাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে যুগে যুগে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। যার সর্বশেষ নজির পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দোসররা। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল। চলে গেল ইলিয়াস গুমের ১৩ বছর। ফিরে এলেন না ইলিয়াস প্রিয় শহর সিলেটে। ইলিয়াস আলী গুম হবার পর জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশ এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তার সন্ধানের জন্য তৎকালীন পতিত শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিআহ্বান জানানো হয়েছিলো। শুধু কি আহ্বান জানানো হয়েছিলো স্বয়ং উনার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী রেজিস্ট্রার বেগম তাহসিনা রুশদীর লুনা সন্তানদেরকে নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি দেখা করে মানবিকতার কথা চিন্তা করে ইলিয়াস ভাইকে খুঁজে বের করে দেওয়ার অনুরোধ পর্যন্ত করেছিলেন। কিন্তু যে কিনা স্বয়ং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে সরাসরি জড়িত তার কাছে এসব অনুরোধ তো শুধুমাত্র অনুরোধ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। দেখতে দেখতেই দিন মাস বছর পেরিয়ে আজ ১৩ বছর হয়ে গেলো প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলী বিহীন অপেক্ষার পথ চলার। নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস সাহেবের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে কলিজার টুকরো সন্তান ফেরার পথ পানে চেয়ে থাকা বৃদ্ধা মা সুর্যবান বিবি, স্ত্রী, সন্তানসহ আমরা দলীয় নেতা-কর্মী ও সমগ্র সিলেটবাসী আশায় বুক পেতে ছিলাম খুনি হাসিনা ও তার দোসররা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবার হয়তো আমাদের প্রিয় নেতাকে ফিরে পাবো। জানিনা এ পথ পানে চেয়ে বসে থাকার অনন্ত অপেক্ষা কবে শেষ হবে। তবে যতদিন বেঁচে থাকবো তোমার ফেরার আশায় থাকবো এবং তোমার আদর্শকে আঁকড়ে ধরেই এ পিচ ঢালা পথ চলবো। সিলেটের কৃতি সন্তান এম ইলিয়াস আলীকে সিলেট বাসীর হৃদয় থেকে কখনো মুছা যাবেনা। কারণ ভালোবাসার অবিনশ্বর সফটওয়ারে সেইভ হয়ে আছেন জনতার ইলিয়াস। এই মুহুর্তে অন্তর থেকে দোয়া করি যেখানেই থাকো ভালো থেকো অন্তরাত্মার আত্মীয় প্রিয় নেতা ইলিয়াস ভাই।
লেখক- মোঃ সুবের আহমেদ।
সভাপতি, ৩নং পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়ন যুবদল ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক, ওসমানীনগর থানা ছাত্রদল।