নারী দিবস : আমাদের অবস্থা অতঃপর পরিবর্তনকে অনুপ্রাণিত করা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০১৭, ৯:১২ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবসে আমাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া থাকে। প্রতি বছর নারী দিবসে আমরা নতুন করে শপথ নিই নারীকে কিভাবে সমাজে সমতা দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিভাবে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে পুরুষের পাশাপাশি স্থান দিয়ে সুযোগ সৃষ্টি করা যায়।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে নিম্নতম মজুরি আর মানবেতর কর্মপরিবেশের বেড়াজাল থেকে নারীর কর্মক্ষমতাকে মুক্ত করতে এবং মজুরি বৈষম্যমুক্ত, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ও সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের দাবিতে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে । এ দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্থাব করেছিলেন জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন ১৯১০ সালে। ১৯১১ সালে প্রথম বেসরকারিভাবে বিভিন্ন দেশে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এর দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে দিনটিকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সরকারিভাবে নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হওয়ায় ৮ মার্চ নারী দিবস পালন করে থাকে এবং দিনটিতে নারী সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
অতি দুঃখের বিষয় হলো যে বিগত ১০০ বছর ধরে ৮ই মার্চকে নারী দিবস হিসেবে পালন করলেও আজ ১০০ বছর পরে নারী যে জায়গায় থাকার কথা আজো পৃথিবীতে আমরা নারীদেরকে সেসব জায়গায় দেখিনা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত আমাদের দুই নেত্রীর জন্য। দুই নেত্রীই গৃহবধু থেকে নিজ গুন, নেতৃত্ব, ধৈর্য ও শক্তিমত্তা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছেন। সে হিসেবে আমাদের দেশের নারীদের যে পরিমান উন্নতি সাধন হওয়ার কথা ছিলো তা হয়নি। পরিসংখ্যান ও গবেষনাপত্রগুলো তাই বলে। দেশের কর্মক্ষম নারীর যে অংশটুকু কাজ করছেন তার মধ্যে শতকরা ৯০ভাগই আছেন গার্মেন্টস সেক্টরে। অথচ গার্মেন্টস সেক্টরে তাদেরর ন্যায্য বেতন ভাতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কোনভাবেই স্ট্যান্ডার্র্ড নয়। এইসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের দেশের অনেক কর্মজিবী নারীকে জিবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে মালিক পক্ষ ও সরকারী বাহিনীর রোষানলে পরে।
বাংলাদেশে নারীদের উন্নতি কল্পে যদিও অনেক দেশি বিদেশি সংস্থা কাজে নেমেছে অনেক আগে থেকেই। এই ব্যাপারে অনেক এনজিও কাজ করছে। কিন্তু সার্বজনীন উন্নতি এখনও হয়নি। এখনও আমরা একটা শক্ত সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। এখনও আমাদের সমাজে নাদিয়া, রাবেয়াদের মত মেয়েরা অহরহ ধর্ষিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে তারা নানা রকম বৈষম্যের মুখে পড়ছে।
সামাজিক কুসংস্কার, যৌতুক প্রথা, এসিড নিক্ষেপের মত নির্মম সব ঘটনার শিকার হতে হয় নারীদের। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এখনও আমাদের দেশে আছে। এগুলোর উচ্ছেদ ও নারীদের সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা কতটা জরুরী আমরা উপলব্ধি করছি না। কোন দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে পঙ্গু করে দিয়ে সামনে আগানো যায় না।
আমার শুধু নিজেকে যাচাই করেই নয় সার্বিক ভাবে জানতে ইচ্ছে করে আমাদের দেশের নারীরা কতখানি ভালো আছেন, কতটা স্বস্তিতে আছেন? আমরা বাংলাদেশে শুধু নারী দিবসই নয়, বেগম রোকেয়া দিবস, শিশু কন্যাসন্তান দিবস ইত্যাদি অনেক দিবসই পালন করি। কিন্তু এসব দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা কেন এসেছে সেটা একটু ভাবলেই আমরা পেয়ে যাই। কোনো মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেই প্রতিবাদ করতে চায়, রুখে দাঁড়াতে চায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সেখান থেকে কথা ওঠে ন্যায্য অধিকার এবং সম্মানের, প্রয়োজন দেখা দেয় আলাদা করে দিবস উদযাপনের।
লেখকের ভাষায় বলতে চাই,ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, “মানব দেহে যেমন দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা, সমাজ দেহে তেমনি নর-নারী। যে দেহে এক চোখ কানা, এক হাত লুলা, এক পা খোঁড়া, সে দেহ বিকলাঙ্গ। নারী জাতির সুষ্ঠু উন্নয়ন ব্যতীত সমাজকে সমুন্নত বলা যাবে না।”
তবে অনেকেই বলে থাকেন, নারী আর পুরুষ সমান হতে পারে না, কারণ নারী দুর্বল। ব্যাপারটা শুধু এই যুগে এসে কেন, অতীতের ক্ষেত্রেও একটা অগ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসেব উপস্থাপিত হতে পারে। উর্দু সাহিত্যের লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর “ লাইসেন্স” নামক গল্পে জনৈক নারীর স্বামী মারা যাবার পর তার ঘোড়ার গাড়ির লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়। জীবিকার উপায় হিসেবে তাকে বলা হয় বাজারে বসতে। সভ্যতার মুখোশ পরা এই আমরাই যে বেশ্যাবৃত্তিকে সমর্থন করে ফেলি অজান্তেই এই বোধ কি আমাদের আছে?
তবে আমি স্বপ্ন দেখি যেদিন আর নারীদের জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হবেনা। মানুষের কাতারে তারাও এসে সমভাবে উপস্থিত হবেন। এছাড়া অপ্রিয় হলেও সত্য পুরুষরা সঠিক অর্থে শিক্ষিত না হলে নারীদের অধিকার সুনিশ্চিত হবে না।
শুধু নারী দিবস বলেই একটি নির্দিষ্ট দিনে আমরা নারীদের নিয়ে ভাববো, তাকে সম্মান দিবো তা নয়। আসুন আমরা নারীকে তার যথাযথ সম্মান দেই, তাকে দেই তার সদিচ্ছা পূরণের অধিকার, তাকে ভাবতে শিখি স্বতন্ত্র একজন মানুষ হিসেবে ।
লেখকঃ জুনেদ আহমদ
শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।