জকিগঞ্জ পাক-হানাদার মুক্ত দিবস আজ: আজও পায়নি প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ নভেম্বর ২০১৬, ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
আজ ২১ নভেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা শত্রুমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে ১২ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় অসংখ্য আহত নিহতদের রক্তের বিনিময়ে জকিগঞ্জ থানা সদরসহ আশপাশ এলাকা হানাদারমুক্ত করা হয়েছিলো।
এ দিন যথাযথভাবে পালন করতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও লাল-সবুজ ছাত্র ফোরাম দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সকাল ১১টায় জকিগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যে দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়ে দোয়া মাহফিল, র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল ২১ নভেম্বরের স্মৃতিচারণ করে জকিগঞ্জের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন- পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস, খনতি বাহীনি যখন সারাদেশে তাণ্ডব অব্যাহত রেখেছিল তখন বিরাঙ্গনের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন সারাদেশে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই জকিগঞ্জকে মুক্ত করতে হবে। সেই মতে একাত্তরের ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলোয় এক গোপনীয় বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের খতমের সিদ্ধান্ত হয়।
২৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আবদুল ওয়াহাব, সিগন্যালম্যান আবদুল মোতালেব প্রমুখ প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাকসেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। ৩ এপ্রিল মরহুম এমএলএ দেওয়ান ফরিদ গাজী ভারতের করিমগঞ্জে গিয়ে সেখানকার ডিসি, এসপিসহ আসাম সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশী শরণার্থীদের থাকা খাওয়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। সহজেই জকিগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে সাবেক এমপি মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএলএ আবদুল লতিফ, এমএলএ আব্দুর রহিম, সেক্টর কমান্ডার চিত্তরঞ্জন দত্ত, মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচিসহ ভারতের মাছিমপুর ক্যান্টলম্যান্টে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ঐ পরিকল্পনা ছিল কীভাবে কুশিয়ারার ওপারে ভারতের করিমগঞ্জের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত না-করে জকিগঞ্জ শত্রুমুক্ত করে দখল করা যায়। পরিকল্পনা মতই জকিগঞ্জ মুক্ত হয়। সাঁড়াশি অভিযানের পূর্বে অন্য কেউ এমনকি অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও এ ব্যাপারে জানতেন না।
অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী, তৎকালীন এমপি আব্দুল লতিফ, ইসমত চৌধুরী ও আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী প্রমুখ।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও পৌর মেয়র খলিল উদ্দিন বলেন- সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জকে মুক্ত করার পরিকল্পনা অনুসারে ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দল লোহার মহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলসীদের দিকে অগ্রসর হয়। মূল দল জকিগঞ্জের কাস্টমঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাস্টম ঘাটে অবস্থান নেয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিবাহিনীর অভিযানের মূখে দখলদার পাকবাহিনী দিক্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দল ভারত থেকে জকিগঞ্জে পৌঁছে যায়। মূল দল কুশিয়ারা নদীতে সেতু তৈরি করে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তখন জকিগঞ্জ কাস্টমঘাটের নদীচরে পাকসেনাদের বুলেটে শহীদ হন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর চমন লাল সিং ও তার দুই সহযোগী। এসময় কয়েকজন পাক সেনাকে আটক করা হয়। এভাবেই মুক্ত হয় জকিগঞ্জ।
২০ নভেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর এক সাঁড়াশি অভিযানের ফলে মৃত্যুর মিছিলগুনে ২১ নভেম্বর ভোরে হানাদারমুক্ত হয় জকিগঞ্জ।
একুশে নভেম্বর ভোরে জকিগঞ্জের মাটিতেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক আটককৃত বন্দিদের জকিগঞ্জ থানা থেকে মুক্ত করা হয়।
তিনি আরও জানান- জকিগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধারা এমএলএ আব্দুল লতিফ, কুটুলা আজি, নিছার আলী মক্তার, বজলুল হক চৌধুরী প্রমুখের উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
২২ নভেম্বর জেড-ফোর্সের অধিনায়ক সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান জকিগঞ্জে প্রবেশ করেন। ২৯ নভেম্বর জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দাউদ হায়দারকে জকিগঞ্জের বেসামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। শত্রুমুক্ত এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনাম চৌধুরীকে প্রধান করে ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদকে স্পেশাল কামান্ডার ও এনামুল মজিদ চৌধুরীকে উপ-প্রধান করে ও বর্তমান জকিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও পৌর মেয়র খলিল উদ্দিনকে সহকারী কামান্ডার নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। কিন্তু আজও জকিগঞ্জকে বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। প্রতি বছরই মনে ক্ষোভ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া ২১ শে নভেম্বর পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ ছিল ৪নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত) নেতৃত্বে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি ছিলেন উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জোনের ৪ ও ৫নং সেক্টরের বেসামরিক প্রধান উপদেষ্টা। ৬টি সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আত্মার মাগফিরাত করে বলেন- ২১ নভেম্বর জকিগঞ্জ শত্রুমুক্ত করে আমরা ২৮ নভেম্বর প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। আমি ছিলাম আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে। তখনো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বভাবিক ছিলো। তিনি জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চল রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।