ভাইরাল হওয়া সেই স্ট্যাটাসটি গরীবের ডাক্তার মঈনের স্ত্রীর নয়!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ এপ্রিল ২০২০, ৯:৩৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
করোনাযুদ্ধে দেশে প্রথম হারমানা চিকিৎসক ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈনুদ্দিন। করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি।
অকালে ঝড়ে পড়া একটি মানবতার ফুলের জন্য গোটা উপজেলাবাসী আজ নীরবে কাঁদছে। সামাজিক যোগাযোগ গণমাধ্যমেও অনেকে সহমর্মিতা জানিয়েছেন তার পরিবারের প্রতি।
বুধবার ভোরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
সম্প্রতি গরীবের ডাক্তার মঈন উদ্দিনের স্ত্রীর নামে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়। যা অনুসন্ধানে সত্য নয় বলে প্রমাণিত করা হয়েছে।
যে স্ট্যাটাসটি গরীবের ডাক্তার মঈনের স্ত্রীর নামে অনেকেই শেয়ার দিচ্ছেন তার প্রকৃত লেখক আরেক চিকিৎসক ড. উম্মে বুশরা সুমনার। তিনি শুক্রবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ডা. মঈন স্যারের স্ত্রীর নাম ডা. রিফাত জাহান।
উম্মে বুশরা ফেসবুকে লেখেন, কী লিখব বুঝতে পারছি না। আমার লেখা একটা পোস্ট এডিট করে সামনে প্রয়াত ডা. মঈন স্যারের স্ত্রীকে বসিয়ে দিয়েছে। ডা. মঈন স্যার ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন। স্যার সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করতেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। একজন ভালো মুসলিম ছিলেন, মানবিক মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতবাসী করুক।
‘আমার হাসবেন্ড ডাক্তার আরিফুর রহমান মাসুমও ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন। এরপর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট করেন। দুইজনের মধ্যে এইটা মিল আছে। ডাক্তার মঈন স্যারের স্ত্রীর নাম ডাক্তার রিফাত জাহান। স্যার মারা গেছেন, একজন মৃত মানুষের নামে ভুল তথ্য প্রচার করা উচিত নয়।’
‘যারা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আমার পোস্ট এডিট করে ডাক্তার মঈন স্যারের স্ত্রী লিখেছেন, তারা আল্লাহর ওয়াস্তে পোস্টটি এডিট করেন। এখন ফিতনার যুগ, ভুল সংবাদে চারদিকে সায়লাব হয়েছে। হাটহাজারীর শফি হুজুর মারা যাননি অথচ তার মৃত্যু সংবাদে সয়লাব আবার নারায়ণগঞ্জের আইভি রহমানের কয়েকদিন আগে মৃত্যু সংবাদ গণহারে প্রচার করা হয়েছে।’
উম্মে বুশরা লেখেন, ‘আসুন, কোনো খবর এলে তার সত্য মিথ্যা যাচাই করি। কোনো খবর বা লেখা কোনোভাবেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করা উচিত নয়, বরং যাচাই করা দরকার। আসুন কোনো কিছু শেয়ার করার আগে তা যাচাই করে নেই।’
আর যে স্ট্যাটাসটি ডা. মঈনের স্ত্রীর বলে ভাইরাল হয়, সেটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল:
‘১) আমি তিনটা বছর একা কষ্ট করেছি, কী পরিমাণ কষ্ট সেটা কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে না। সেই তিন বছর আমার হাসবেন্ড উচ্চতর ডিগ্রি নিতে সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজে ছিলেন। সরকারি কোনো টাকা পেতেন না।
আমি চাকরি করে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া, খাওয়া খরচ একা চালিয়েছি। ভয়ে কম খেতাম, কোনো আত্মীয়-স্বজনের দাওয়াতে, বিয়েতে খরচের ভয়ে যেতাম না। কম খাওয়ার দরুন আমার গর্ভের সন্তান পুষ্টি পায়নি, গ্রোথ রেস্ট্রিকশন ধরা পড়েছিল। আমি একজন ডাক্তারের স্ত্রী। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করা ডাক্তার।
২) অনারারি করা ডাক্তারেরা এক পয়সাও পেতেন না। তাদের ‘অনাহারী’ বলে উপহাস করা হয়। অথচ তাদের সংসার আছে। আমার পরিচিত এক ডাক্তার ভাই সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হন পরিবার চালাতে। একজন ডাক্তারের কথা শুনেছিলাম যে তিনি তার বাচ্চার জন্য দুধ কিনে দিতে পারতেন না। সবাই ভাবে ডাক্তারদের অনেক অনেক টাকা। টাকার বস্তা নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায়।
এমবিবিএস পাস করার পর হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তারদের বেতন কত জানেন? কোনো মেডিকেল কলেজ দেয় ১৫ হাজার, কেউ ১৮ হাজার। গুলশানের একটা নামকরা মেডিকেল কলেজ একজন এমবিবিএস পাস করা লেকচারারকে ১২ হাজার টাকা বেতন দিত। এখন কত দেয়, জানি না।
এই সামান্য টাকায় তারা কীভাবে সংসার চালাবে?
সরকারি ডাক্তারদের বেতন একই স্কেলের ক্যাডারদের বেতনের সমান। বর্তমানে একজন এন্ট্রি লেভেলের নবম গ্রেডের সরকারি মেডিকেল অফিসারের বেসিক বেতন ২২ হাজার টাকা। অথচ তারা কী পরিমাণ ডিউটি করেন, জানেন?
আমার দুই বোন সরকারি ডাক্তার। ওদের সন্তানেরা কতটুকু বঞ্চিত হয়েছে তা আমি দেখেছি। দিনের পর দিন বাচ্চাদের ডিপরাইভ করেছে। দিন শেষে কী পেয়েছে? আমজনতার গালি, কসাই উপাধি।
আমার আরেক বোন সরকারি কলেজে আছে, তাদের সরকারি শিক্ষা ছুটি দেখলে চোখ কপালে উঠবে। রামাদানের প্রায় পুরো মাস ছুটি। আর আমার ডাক্তার বোন ঈদের পরের দিনও ডিউটি করেছে। হাসপাতালে হিন্দু ডাক্তার না থাকায় ঈদের দিনের এক শিফটে তাকে ডিউটি করতে দেখেছি।
যখন আপনারা চাকরিতে ঢুকে আরাম করেছেন, বউ-বাচ্চাকে সময় দিয়েছেন, হানিমুন করেছেন, তখন তারা চাকরি করে পেটের ক্ষুধা মিটিয়েছেন আবার রাত জেগে পড়েছেন একটা ডিগ্রির জন্য যাতে তাদের পরবর্তী জীবন সহজ হয়। কত রাত, কত দিন গেছে, কল্পনাও করতে পারবেন না। সব আনন্দ, সবকিছু তুচ্ছ করে তারা কাজ করেছেন, দিন শেষে রাত জেগে পড়াশোনা করেছেন।
আমি আমার বিয়ের প্রথম জীবনে আমার ডাক্তার স্বামীর কাছে সময়, টাকা তেমন কিছুই পাইনি। যখন অন্যরা আনন্দ করতে ব্যস্ত, তখন আমরা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অথচ আমজনতা ভাবে ডাক্তারেরা টাকা নিয়ে বসে আছে।
গ্রাম থেকে আমার বাসায় আসা অর্ধশিক্ষিত রোগীও প্রফেসরকে দেখাতে চান যার হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে। তাদের সামান্য অসুখে কম ভিজিটের জুনিয়র ডাক্তারকে দেখালেও পারত। অথচ তারা নামকরা প্রফেসর ডাক্তার দেখাতে চান।
এই নামকরা প্রফেসরের বয়স কত? তার জীবনের সংগ্রামের গল্পটা কেউ জানেন? দিন শেষে ডাক্তারকে তারা গালি দিয়ে গেছে, তিন মিনিটে হাজার টাকা? বাপরে বাপ!বিদেশি ডাক্তারের মুখ দিয়ে মধু বের হয়, কথা সত্য।
দেশি ডাক্তারেরা, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারেরা সময় দেন না, মুখ দিয়ে মধু বের হয় না। দিনে কত রোগী আসে জানেন? কত রোগীর বিপরীতে কতজন ডাক্তার থাকার কথা আর কতজন আছেন, হিসাব বলতে পারবেন?
গত বছর আমার ছোট মেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। উত্তরার একটা নরমাল হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম, তারা যখন আশা ছেড়ে দিল, আমরা একটা আইসিইউএর জন্য রাতের বেলা হন্যে হয়ে ঘুরি। তখন সব হাসপাতাল রোগীতে ভর্তি, কোথাও ফাঁকা নেই।
শেষমেশ একজন ডাক্তার ভাইয়ের রেফারেন্সে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারি। এই হাসপাতাল বিদেশি ডাক্তারে ভরপুর। নিট এন্ড ক্লিন, একটু পর পর বাচ্চার পছন্দ অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার সাপ্লাই দিয়ে যায়। নার্স, আয়া, ক্লিনার, পুষ্টিবিদ, ডাক্তার সবাই হাসিমুখে কথা বলে। কী তাদের ব্যবহার! মধু মধু!
এই হাসপাতালে একদিনের আইসিইউ-এর বিল জানেন? আমরা ধারে বিল শোধ করেছিলাম, কত মাস লেগেছে সেই ঋণ শোধ করতে সে গল্প আর বললাম না।
টাকা খরচ করলে মধুর ব্যবহার পাওয়া যায়, সেটা দেশে হোক বা বিদেশে। ডাক্তারদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। তারা জীবন বাজি রেখে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তার বিনিময়ে তারা কয় টাকা বেতন পাবে? সরকারি চাকরিজীবী ডাক্তারদের বেতন সবাই জানে। বেসরকারি হাসপাতালের একজন ডিউটি ডাক্তারের বেতন অনেক সময় একজন গার্মেন্টসকর্মীর বেতনের সমান হয়। রোগীর টাকা অধিকাংশটাই মালিক পায়। ডাক্তার নয়। তিনি তো সামান্য কর্মজীবী।
সরকারি মেডিকেলের অব্যবস্থাপনা, হুইল চেয়ার নেই, বেড নেই, ইকুপমেন্ট নেই, এর দায় কার? ডাক্তার তো সামান্য চাকরিজীবী। তাদের এ সব ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা নেই। আপনি আসল জায়গায় নাড়া দেন।
প্লিজ ডাক্তারদের পেছনে লাগিয়েন না। তারা ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হয়েছে? আপনি ট্যাক্সের টাকায় পড়েননি? সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ট্যাক্সের টাকায় চলছে। তাহলে কেন শুধু ডাক্তারদের দিকে আঙ্গুল উঠান?
যারা ত্রাণের চাল মেরে খাচ্ছে, বিদেশে আনন্দ ভ্রমণ করেছে, ট্রেনের স্লিপারে বাঁশ লাগিয়ে মানুষ মেরেছে, দুর্নীতিবাজ সরকারি ইঞ্জিনিয়ার, বালিশ কেলেঙ্কারি, পর্দা কেলেঙ্কারির নায়কেরা, ব্যাংক ডাকাতরা এদের ধরেন। যারা অসৎ ডাক্তার তাদেরকেও ধরেন, কিন্তু গণহারে ডাক্তারদের গালি দিয়েন না। তাদের উৎসাহ দিন, কাজ করতে দিন।’
এ সব মিথ্যা তথ্য দিয়ে সামাজিকভাবে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন ছাতকবাসী সচেতন মহল।
এ দিকে গরীবের ডাক্তার মঈনের স্ত্রী সেজে ভুয়া আইডি দিয়ে অপপ্রচার করার এ ঘটনার তীব্র ও প্রতিবাদ করেছে গরীবের ডাক্তারের সহকারী সৈয়দ আহমদ কবির, ছাতক উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবুল লেইছ মোহাম্মদ কাহার, জাতীয় কাব্যকথা সাহিত্য পরিষদের সুনামগঞ্জ জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনোয়ার হোসেন রনি, সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম হিরন, হাসান আহমদ, অলিউর রহমান।
গরীবের ডাক্তারের পবিরারের পক্ষ থেকে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন ডা. মঈনের ছোট বোন সিলেটের সুজাতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সাবিরা খাতুন, তার স্বামী সুনামগঞ্জের প্রাইমারি টিচারস ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক এম খসরুজ্জামান।
রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ডা. মঈনকে নিয়ে তাদের গর্বের কথাও বলেন তারা। একই সঙ্গে গরীবের ডাক্তারের জীবনের আরও অনেক অজানা বিষয় যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেন তারা।