কুলাউড়ায় শতবর্ষী মাদরাসায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রশাসনিক কাজ বন্ধ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ৬:০৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জালালিয়া দাখিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি সন্তোষজনক ফলাফল অর্জন করলেও বর্তমানে প্রতিষ্টানে নেমে এসেছে অন্ধকারের ছোঁয়া। মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সুপারের একচ্ছত্র ক্ষমতার দাপটে প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
মাদরাসার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় এক মাস ধরে মাদরাসা সুপার মো. আব্দুস শহীদ জেলহাজতে রয়েছেন। মাদরাসা ব্যবস্থাপনা (স্থগিত) কমিটির সভাপতি মো. আব্দুর রউফ ও সুপার আব্দুস শহীদের আশীর্বাদপুষ্ট শিক্ষক আব্দুস সামাদ মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের চাবি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহকারী সুপারকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।
যার কারণে প্রশাসনিক কাজে মাদরাসার অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসাপত্র নেওয়া সহ দাপ্তরিক সকল কাজের জন্য বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটি মেয়াদউত্তীর্ণ হলেও স্থগিত কমিটির সভাপতির কারণে নতুন কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে দুর্নীতির কবল থেকে মাদরাসাকে রক্ষা করতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এডহক কমিটি গঠন ও ভারপ্রাপ্ত সুপাররের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক ও স্থানীয় এলাকার ৩০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি লিখিত আবেদন করা হয়। যার অনুলিপি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্টার, জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার, জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবরে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া একই তারিখে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্বের জন্য ইউএনও বরাবরে মাদরাসার ১০ জন শিক্ষকের স্বাক্ষরিত আরেকটি আবেদন করা হয়। আবেদনে কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এডহক কমিটি গঠন এবং বর্তমান সহকারী সুপার মাও. মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়।
এদিকে মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং অফিসারের ওপর অনাস্থা এনে নির্বাচন স্থগিত চেয়ে দুই অভিভাবক আব্দুল হান্নান ও মখলিছ মিয়া গত বছরের ১৪ জুলাই হাইকোর্টে একটি পিটিশন (নং-৮৭৩০) করেন।
এদিকে অভিভাবক মো. আব্দুল হান্নানের ছেলে মোস্তাফিজ হোসেন রাহিম নামে শিক্ষার্থী কুলাউড়ার কামারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র বলে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন পত্রে জানা গেছে। কিন্তু সেই রাহিমকে জালালীয়া মাদরাসার ছাত্র দেখিয়ে তার পিতাকে দিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করানো হয়।
মাদরাসার সুপার আব্দুস শহীদ কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার দশম শ্রেণীর ছাত্রীর বাবা গত বছরের ১৯ আগস্ট মৌলভীবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে মামলা দায়ের করলে মামলাটি আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ তদন্তের পর পিবিআই অভিযুক্ত সুপার আব্দুস শহীদকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। এরই প্রেক্ষিতে আদালত ৮ জানুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী করায় সুপার আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯০৩ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলি ফুলতলী (রঃ) ও বিশকুটি (রঃ) এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভূক্তি লাভ করে। বিগত এক দশক থেকে মাদরাসায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। বিধি মোতাবেক নতুন কমিটি গঠনে প্রশাসনের কোন আদেশ কার্যকর হচ্ছে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার একাধিকবার মাদরাসা সুপারকে পত্র ইস্যুর মাধ্যমে মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি গঠনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেও সুপার তাতে কর্ণপাত করেননি। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে আবেদন করেন মাদরাসার সুপার মাও. আব্দুস শহীদ। এরই প্রেক্ষিতে ইউএনও পরবর্তীতে ১৭ জুন শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন।
প্রিজাইডিং অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনী তফশীল ঘোষণার লক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানে অনুরোধ জানালেও সুপার আব্দুস শহীদ প্রিসাইডিং অফিসারকে কোন তথ্য দেননি। প্রয়োজনীয় তথ্য না পেয়ে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে পারেননি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। পরবর্তীতে নির্বাচনের তফসিল কেন ঘোষণা হলো না মর্মে ইউএনও ফের ১১ জুলাই পত্র ইস্যুর মাধ্যমে সুপারকে অনুরোধ করেন। তাতেও সাড়া দেননি সুপার শহীদ।
মাদরাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি, বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক, কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনি তাঁর ক্ষমতার প্রভাব খাঁটিয়ে সুপার আব্দুস শহীদকে দিয়েই সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদরাসা পরিচালনা করে আসছিলেন। যার কারণে মাদরাসায় বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি একবার নির্বাচিত সভাপতি হলেও বাকি কয়েক মেয়াদে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদরাসার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট গঠিত কমিটির প্রথম সভায় যে ৮ জন অভিভাবক সদস্যদের উপস্থিতি উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অনেকেই জানেন না তারা এই কমিটির সদস্য আছেন কি না। মাদরাসার অভিভাবক সদস্য বাবুল মিয়া বলেন, ২০১৭ সালে আমাকে সদস্য করা হয়েছে বলে জানানো হয় কিন্তু এরপর মাদরাসা কমিটির কোনো সভায় একদিনও আমাকে ডাকা হয়নি। সভায় আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। আরেক মহিলা অভিভাবক সদস্য লিলা বেগম বলেন, একদিন কমিটিতে রাখার জন্য নাম নিলেও কোনো সভায় আমাকে দাওয়াত করা হয়নি। আমি সদস্য আছি কি না তা জানি না।
এ ব্যাপারে মাদরাসা ব্যবস্থাপনা (স্থগিত) কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ বলেন, মাদরাসায় শিক্ষকদের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্ধের কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমানে নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এদিকে আপনার দ্বারা মাদ্রাসার বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে ও সুপার জেলহাজতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম থাকলে সেখানে আইন আছে। মাদরাসায় কোনো অনিয়ম হয়নি আর সুপার কোথায় আছেন জানি না তবে সুপার আমার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন।
বর্তমানে মাদরাসার প্রশাসনিক কার্যকম কিভাবে চলবে আমি মানুষ ঠিক করে দিয়েছি। বর্তমানে মাদরাসার কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। অন্য এক স্কুলের ছাত্রকে মাদরাসায় ভর্তি দেখিয়ে তাঁর পিতাকে দিয়ে হাইকোর্টে পিটিশন কিভাবে করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন সবাই জানে না, একজনের পক্ষে আরেকজন পিটিশন করতেই পারে। মাদরাসার পরিবেশ নষ্ট করার জন্য একটি মহল এসব ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আনোয়ার বলেন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে মাদ্রাসা সুপারের অসহযোগিতার কারণে কমিটি গঠনে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। আর ভারপ্রাপ্ত সুপারের বিষয়ে ইউএনও মহোদয়ের সাথে আলোচনা করব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, মাদরাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে মাদরাসার কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের আরো আন্তরিক হতে হবে। মাদরাসায় কমিটি না থাকায় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের কোন নির্দেশনা পাইনি। শুধু আমার স্বাক্ষরে পরিপত্রের আলোকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুপারের অবর্তমানে সহকারী সুপার দায়িত্ব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।