নিল আর্মস্ট্রংদের চন্দ্রজয়ের নেপথ্যে সিলেটের পাখি মিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০১৭, ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
চাঁদে প্রথম পা রাখেন নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। ১৯৬৯ সালে বিস্ময়জাগানিয়া সেই চন্দ্র অভিযান পুরো পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যার নেপথ্যে কাজ করেছেন অনেক মানুষ। বাংলাদেশের একজনও ছিলেন এই তালিকায়। তাঁর নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার গঙ্গানগর গ্রামে। এই মানুষ পাখি মিয়া নামেই বেশি পরিচিত।
রফিক উদ্দিন আহমেদ পেশায় ছিলেন তড়িৎ প্রকৌশলী। মহাকাশচারীদের অ্যাপোলো ১১ নভোযান থেকে চাঁদে নিয়ে যায় যে লুনার মডিউল, সেটার নকশা প্রণয়ন ও কারিগরি কাজে যুক্ত ছিলেন রফিক উদ্দিন আহমেদ। এখন তাঁর বসবাস নিউইয়র্কের স্মিথটাউন শহরে। তাঁর গল্প শুনতেই স্মিথটাউনে যাওয়া। ঝাপসা স্মৃতি হাতড়ে তিনি শোনালেন অ্যাপোলো ১১-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার সেই গৌরবের গল্প।
রফিক উদ্দিন আহমেদ তখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুম্মান অ্যারোস্পেস করপোরেশনের তরুণ কর্মী। সামরিক ও বেসামরিক বিমান তৈরি করত এই প্রতিষ্ঠান। তিনি তখন এফ-১৪ জঙ্গি বিমান তৈরির একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। রফিক উদ্দিন আহমেদ ফিরে গেলেন সেই দিনগুলোতে, ‘এই প্রকল্প চলার সময়ই আমাকে এবং সহকর্মী আরও কয়েকজন প্রকৌশলীকে অ্যাপোলো-১১ প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা—নাসার কাজের ধরনটাই এমন। তারা মূল প্রকল্পকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে আলাদাভাবে কাজ করায়। আমাদের প্রতিষ্ঠান পেল লুনার মডিউল প্রকল্পের কাজ।’
লুনার মডিউলের কাজ ছিল মহাকাশচারীদের অ্যাপোলো ১১ থেকে চাঁদে নিয়ে যাওয়া। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করানো এবং সেখানে তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শেষ হলে আবার তাঁদের মহাকাশযানে ফিরিয়ে আনা।
রফিক উদ্দিন আহমেদ ও তাঁর দলের কাজ ছিল লুনার মডিউলের নকশা তৈরি ও কারিগরি দিকগুলো দেখা। একজন তড়িৎ প্রকৌশলী হলেও তিনি মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠান থেকেও পেয়েছেন প্রশিক্ষণ। তাই কাজটি তাঁকে যেমন রোমাঞ্চিত করেছিল, তেমনি নতুন অভিজ্ঞতারও স্বাদ দিয়েছিল।
একসময় লুনার মডিউল তৈরি হয়ে গেল। চন্দ্রাভিযানের নভোচারীদের এই যন্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল রফিক উদ্দিন আহমেদ ও তাঁর দলের ওপর। লুনার মডিউল কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে হয়, সেসব বিষয় শিখিয়ে দেওয়াই ছিল প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করায় মহাকাশচারীদের সঙ্গে রফিক উদ্দিন আহমদের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
প্রকল্পের কাজ শেষে তাঁদের চিন্তা ছিল অভিযান সফল হবে তো? ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই চাঁদের উদ্দেশে পৃথিবী ছাড়ে অ্যাপোলো ১১। চন্দ্র অভিযানের অধিনায়ক ছিলেন নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং, লুনার মডিউলের পাইলট ছিলেন বাজ অলড্রিন। চাঁদের অভিযাত্রীরা পৃথিবীতে সফলভাবে অবতরণের মধ্য দিয়ে কাজ সমাপ্ত হয় রফিক উদ্দিন আহমদের। রচিত হলো নতুন ইতিহাস। সে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন বাংলাদেশের রফিক উদ্দিন আহমেদ।
লুনার মডিউলের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার সনদ গঙ্গানগর থেকে নিউইয়র্ক
রফিক উদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২০ আগস্ট। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার গঙ্গানগর গ্রামে। বাবা ইদ্রিস আলী ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে রফিক তৃতীয়। গঙ্গানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর ভর্তি হন সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে তাঁর। ‘কারণ আমার বিশ্বাস ছিল, সেখানে যেতে পারলে আমি বড় কিছু করতে পারব। নিজের পরিবারের জন্য, দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারব।’ বললেন রফিক আহমেদ।
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৪ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ইন্ডিয়ানা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তড়িৎ প্রকৌশলে। পড়াশোনা শেষে তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি নেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সামরিক ও বেসামরিক বিমান তৈরির প্রতিষ্ঠান গ্রুম্মান অ্যারোস্পেস করপোরেশনে।
স্ত্রী কান্তা আহমদ ও দুই মেয়ে মল্লিকা কালেন্দ্রা ও জামিলা সেভাককে নিয়েই তাঁর এখনকার জীবন। বড় মেয়ে মল্লিকা তড়িৎ প্রকৌশলী হয়েছেন। এই বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট মেয়ে জামিলা ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন নিউইয়র্কের একটি প্রতিষ্ঠানে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেই।
এখনো স্বদেশের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান রফিক উদ্দিন আহমেদ। প্রিয় গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর দেশে থাকা বন্ধুদের কথা ভাবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে থেকে দেশের জন্য কাজ করেছেন বলে জানালেন তিনি। জাতিসংঘের সামনে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। রফিক উদ্দিন আহমেদের খালাতো ভাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী। তিনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ওসমানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার চিঠি মারফত যোগাযোগ ছিল।’
দেশ নিয়েই কথা বললেন রফিক উদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, যত প্রতিবন্ধকতাই থাক না কেন, বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কারণ, বাংলাদেশিরা প্রতিভাবান।
সূত্র : প্রথম আলো