বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে কারা?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ৬:৫১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
আন্দোলন, পাল্টা আন্দোলন। দফায় দফায় নতুন কর্মসূচি নিয়ে হাজির বিভিন্ন গোষ্ঠী। দাবি আদায়ে দখলে রাখছে রাজপথ। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে যান চলাচল। ভাঙচুর করা হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সম্পদের। ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। বিশৃঙ্খলা চারদিকে। রাজধানীসহ সারা দেশে ক্ষুদ্র ইস্যুতে বড় বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে- বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে কারা। কারা নাড়ছেন কলকাঠি, উস্কে দিচ্ছে আন্দোলনকারীদের। আর এ ধরনের কর্মকাণ্ড রোধে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সহিংসতা থামাতে কেন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না। গতকালও ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা দিয়ে তাণ্ডব চালানো হয়েছে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে। দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কলেজটি। আগের দিনও ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে তাণ্ডব চালানো হয় সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ তিনটি কলেজে। আহত অসংখ্য। সরকারের উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এসব ঘটনার পেছনে অন্য কেউ ইন্ধন দিচ্ছে বলে মনে করছে। এ ছাড়াও পতিত শেখ হাসিনা সরকারের কেউ কেউ এসব আন্দোলনে রসদ যোগাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আছে দেশ-বিদেশি ষড়যন্ত্র। একের পর এক বিশৃঙ্খল ঘটনার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানাভাবে আন্দোলনকারীদের উস্কানি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এ ছাড়াও ভারতীয় মিডিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উস্কে দেয়া হচ্ছে। অপপ্রচার চালানো হচ্ছে আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকেও। কোনো কোনো কর্মসূচিতে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের অনুসারীদের সরাসরি ইন্ধনের অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়াও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে রাজপথে থাকা মিত্রদের কেউ কেউও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অতি বিপ্লবী কর্মসূচি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। এমনকি সরকারে জায়গা না পাওয়া অনেকেও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে দাবি করছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছে। এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বড় কোনো পরিকল্পনা না থাকলে একদিনে এতগুলো ঘটনা কাকতালীয় না। আমরা মনে করছি, এখানে নানা পক্ষের পরিকল্পনা আছে। সরকার সফলভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম করুক, এটা হয়তো অনেকেই চাচ্ছে না। আমাদের যে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা মনে করি, পুলিশে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। প্রশাসনে স্থবিরতা কাটানোর জন্য আমরা একটা বড় পরিকল্পনা করছি। এগুলো নস্যাৎ করতে আমাদেরকে এসব ঘটনায় ব্যস্ত রাখতে এটেনশন এদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা এটা আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। আমরা এটার ইনভেস্টিগেট করছি যে এই ঘটনার সঙ্গে দেশে কিংবা দেশের বাইরে কারা জড়িত। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের দুর্বলতা ছিল। দুর্বলতা ছিল বলেই এটি সংঘর্ষের দিকে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে অস্থিরতা নিরসনে গতকাল রাতে রাজধানীর রূপায়ণ টাওয়ারে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর জরুরি বৈঠক হয়। যেখানে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন সকলে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও পার্শ্ববর্তী দেশের ষড়যন্ত্র থেকে সচেতন থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বলা হয়, কোনোভাবেই তাদের উস্কানিতে কেউ যেন পা না দেয়। এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শান্ত রাখতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।
গত দুইদিন ধরে রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসকের গাফিলতিতে ড. মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে একাধিক কলেজে। গত রোববার রাজধানীর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও সরকারি কবি নজরুল কলেজে সম্মিলিত তাণ্ডব চালায় বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে সুপার সানডে ঘোষণা দিয়ে চালানো হয় এ তাণ্ডব। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সোহরাওয়ার্দী কলেজ। এর পাল্টা দিতে গতকাল ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা ওই দুই কলেজের শিক্ষার্থী। ঘোষণা অনুযায়ী মাতুয়াইলে গিয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে তাণ্ডব চালায় তারা। সংঘর্ষে পুরো কলেজ পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এ ছাড়াও রাজধানীর সেন্ট গ্রেগরি কলেজেও হামলা চালানো হয়। ওদিকে গত রোববার রাতে ঢাকা পলিটেকনিক ও বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিকে গতকাল শাহবাগে লাখো মানুষের জনসমাগম ঘটানোর পূর্বপরিকল্পনা ভেস্তে গেছে অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের। বিনা সুদে ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সারা দেশ থেকে গাড়িতে করে লোক নিয়ে আসে সংগঠনটি। এ জন্য প্রত্যেককে দেয়া হয় এক হাজার টাকা। এ ছাড়া ঢাকায় আসার দায়িত্বও নেয়া হয়। বিনিময়ে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচির কথা বলা হয় তাদের। কিন্তু শাহবাগে জড়ো হতে ভোরে আসা শুরু করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাধাগ্রস্ত হয় তারা।
শিক্ষার্থীদের জেরার মুখে নিজেদের পরিকল্পনার কথা বলতে বাধ্য হন তারা। পরে তাদের স্ব স্ব এলাকায় ফেরত পাঠানো হয়। আটক করা হয় ৪ জনকে। এ ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় তাদের আটকে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জানা গেছে, শাহবাগে বসে পড়ে অস্থিতরা তৈরি করা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। আটক করা হয়েছে ওই কর্মসূচির মূলহোতাকে। অন্যদিকে দু’টি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে বয়কট করে এ প্রতিষ্ঠান দু’টির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে একদল লোক। তারা পত্রিকা দু’টিকে ইসলামের শত্রু ও ভারতের দালাল বলে দাবি করছে। শুক্রবার ডেইলি স্টারের সামনে জুমার নামাজ আদায় করেন তারা। গত রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে তারা নামাজ আদায় ও ভোজের কর্মসূচি দেয়। পরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আটক করা হয় ৪ জনকে। গতকালও পত্রিকাটির প্রধান কার্যালয় কাওরান বাজারে বিক্ষোভ করেছে ওই গ্রুপটি। এ ছাড়া রাজশাহীতে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা চালায় একদল লোক। এ ছাড়াও বিগত কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। প্রায় প্রতিদিনই তারা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করছেন। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী। এ আন্দোলনেও আওয়ামী লীগসহ সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত বুধবার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয় অনেকে। তার আগে ৭ কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। কয়েক দফায় সড়ক অবরোধ করে চলা এ কর্মসূচিতে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। অন্যদিকে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরাও নিজেদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে কয়েকদিন সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এদিকে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামায়াতের দুই পক্ষের কর্মসূচি পাল্টা কর্মসূচি পালিত হয়। অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেশের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ইস্যুতে নানা কর্মসূচি পালন করছে। এদের ক্ষেত্রেও বিশেষ গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে ডিবি পুলিশ। পরে সংগঠনটির অনুসারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। এর আগে ডিবি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় তারা। পরবর্তীতে শাহবাগ থেকে ইসকন সদস্যদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয় একদল লোক।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, অনেক মিত্রই আজ হঠকারীর ভূমিকায়। আমরা আমাদের ব্যর্থতা স্বীকার করি। আমরা শিখছি এবং ব্যর্থতা কাটানোর চেষ্টাও করছি। তিনি বলেন, বাম ও ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি অভ্যুত্থানে এবং পরবর্তী সময়ে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড দেশটাকে অস্থির করে রেখেছে। অন্যদিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সারজিস আলম এক স্ট্যাটাসে বলেন, সবার আগে দেশ, দেশের মানুষ, জনগণের সম্পদ। যদি কেউ বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, সে যে পরিচয়েরই হোক না কেন তবে দেশের স্বার্থে তাদের প্রতিহত করে জনমানুষের নিরাপত্তা প্রদান করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাজ। আরেক স্ট্যাটাসে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শত চেষ্টার পরেও বসে সমাধান করার আহ্বান জানানোর পরেও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। এগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতি দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও স্ট্রিক্ট অ্যাকশনে যায়নি। কোনো প্রকার অ্যাকশনে গেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সকল পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, এসব হামলা-সংঘর্ষের পেছনে কারও ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানান তিনি।