কলকাতায় পতাকা পোড়ানোয় তীব্র নিন্দা বাংলাদেশের, চিন্ময়ের আইনি অধিকার চায় ভারত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১০ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতি চলছেই। গত কয়েকদিনের মতো শুক্রবারও দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে প্রতিবেশী দেশের উদ্দেশে পারস্পরিক ইস্যুতে বার্তা দেয়া হয়েছে।
কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
‘বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ’ নামে একটি সংগঠনের ‘সহিংস’ প্রতিবাদের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি।
বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে শুক্রবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারী কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে ওই সমাবেশে যোগ দেন যা এক পর্যায়ে সহিংস রূপ নেয়।
“পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে বিক্ষোভকারীরা ভবনের সীমানায় পৌঁছে যান,” উল্লেখ করে এতে আরো বলা হয়, “তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন এবং প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা পোড়ান।”
যদিও এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই মনে করছে বাংলাদেশ।
তবে, ডেপুটি হাইকমিশনের সবার মধ্যে একটা ‘নিরাপত্তাহীনতার বোধ বিরাজ করছে’ বলেও জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে, বাংলাদেশ সকল ধরনের সহিংসতার বিপক্ষে উল্লেখ করে, ভারতে দেশটির কূটনৈতিক মিশনসমূহ এবং এর কূটনীতিক ও অ-কূটনীতিক কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও স্থান পায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা যে হুমকির মধ্যে পড়ছেন এবং তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে, সেই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের কাছে ভারত বারবার উত্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সব সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে।”
“বারবার চরমপন্থী বক্তব্য দেওয়া, সহিংসতা ও উস্কানি দেওয়ার ক্রমবর্ধমান ঘটনা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এই ঘটনাগুলিকে শুধুমাত্র গণমাধ্যমের বাড়িয়ে দেখাচ্ছে বলে নস্যাৎ করে দিলে চলবে না। আমরা আবারও বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে আবেদন জানাতে চাই যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে সব ধরণের পদক্ষেপ নিক তারা,” মন্তব্য মি. জয়সওয়ালের।
ইসকন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত একটি সংগঠন হিসাবেই আমরা ইসকনকে দেখি, যাদের সমাজসেবা করার শক্তপোক্ত রেকর্ড আছে।”
তিনি বলেন, “চিন্ময় দাসের গ্রেফতারি নিয়ে আমরা আগেই একটি বিবৃতি দিয়েছি। ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশা করব এই প্রক্রিয়া ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে চলবে, যেখানে তাদের আইনি অধিকার সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত হবে।”
শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার যে বিবৃতি দিয়েছেন, সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি আবারও শুধু এটুকই বলব যে বাংলাদেশের সরকারের কাছে ভারত সরকার নিজেদের উদ্বেগের কথাগুলো জানিয়েছি যে বাংলাদেশের সরকারকেই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।“
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি যেভাবে চলছে, তা চলতে থাকবে বলেও মন্তব্য করেছেন রণধীর জয়সওয়াল।
অবশ্য শুক্রবারের বক্তব্য ও বিজ্ঞপ্তিকে বিগত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ও সেদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে কথিত হামলার ঘটনা নিয়ে ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলি শুরু থেকেই বেশ আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। গণমাধ্যমেও গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ।
ভারতের প্রধান হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র কড়া বিবৃতির মধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ রেখেছে, তবে পশ্চিমবঙ্গে দলটির নেতারা কর্মী-সমর্থকদের রাস্তায় নেমে বাংলাদেশের ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে গিয়েও বিজেপি নেতাদের একাংশ বাংলাদেশ নিয়ে বেশ আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করছেন।
অন্যদিকে কেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করছেন না, তা নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে দলের একাংশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
আবার ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গত দুদিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দুধরনের প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে জাতীয় স্তরের ইংরেজি ও হিন্দি গণমাধ্যমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনের স্পষ্ট ফারাক আছে বলেই মনে করছেন গণমাধ্যমের বিশ্লেষকরা।
যেখানে জাতীয় গণমাধ্যমগুলিতে বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রাসী ‘প্রতিবাদী’ ধাঁচে খবর দেখানো হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজগুলোতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসে গ্রেফতার ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রম নিয়ে যা লেখা হচ্ছে, তা যথেষ্ট মাপা এবং নিরপেক্ষ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্যেই অবশ্য মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় অপরাধীরা যেখানে ধরা ছোয়ার বাইরে সেখানে একজন ধর্মীয় নেতা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন কথা বলেছে তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিবৃবিতে বাংলাদেশের হিন্দুসহ সকল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহবান জানানো হয়।
অন্যদিকে ভারতের উদ্বেগ প্রকাশের পাল্টা বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, অতিশয় হতাশা ও গভীরভাবে অনুভূতিতে আঘাতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করছে যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর থেকে কিছু মহল তা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন অপ্রমাণিত বিবৃতি শুধু সত্যের অপলাপই নয়, একই সঙ্গে তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থি।