পোকামাকড় খাচ্ছে সিলেটবাসীর সম্পদ !
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০১৭, ২:০৯ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ সিলেটের সম্পদের দলিলাদি খেয়ে ফেলছে ‘উইপোকা’। চোখের সামনেই ‘হিসাব খাতা’ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সব। কিন্তু করার কিছুই নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এ বিষয়ে বারবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি চালাচালি করলেও কাজ কিছুই হয়নি। এতে করে সিলেটবাসীর সম্পদের সব প্রমাণ ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে অনেক দলিল দস্তাবেজ। এগুলোর কোনো হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছেন সিলেটের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তারা।
ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রী ও সিলেটের সাবেক মেয়রের জোরালো পদক্ষেপে রক্ষিত হয়েছে সিলেটের ঐতিহাসিক সাব-রেজিস্ট্রার ময়দান। এতে করে সুরক্ষা পেয়েছে সিলেটের সাব- রেজিস্ট্রারি অফিস রেকর্ডরুম। কিন্তু সুরক্ষা হলেও পোকার কাছ থেকে রক্ষা হচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ। সিলেটের সাব- রেজিস্ট্রার অফিসের রেকর্ডরুমেই রাখা রয়েছে সিলেটবাসীর সম্পদ। জমি রেজিস্ট্রির সকল বৈধতার দলিল থাকে রেকর্ড রুমেই। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান জরাজীর্ণ টিনশেড ভবন থেকে ভবন নির্মাণ করে সিলেটের রেকর্ডরুমকে স্থানান্তর করেছিলেন।
কিন্তু সেটিও পরিকল্পনা মতো না হওয়ার কারণে কোনো ভাবেই রক্ষিত হচ্ছে না সিলেটবাসীর সম্পদের দলিলাদি। নেই স্থায়ী রেকর্ড কিপারও। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তারা জানান, সিলেট সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সাব-রেজিস্ট্রার পদমর্যাদায় থাকার কথা রয়েছে দুজন কর্মকর্তার। এর মধ্যে একজন দলিল সম্পাদন করবেন, আর অপরজন রেকর্ডরুমের দায়িত্বে থাকবেন। গুরুত্বপূর্ণ সব দলিলাদি থাকায় রেকর্ডরুম হচ্ছে সংরক্ষিত এলাকা। ওই এলাকায় রেকর্ড কিপার ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু সিলেটের রেকর্ডরুমের সে অবস্থা নেই। যেহেতু নির্ধারিত কর্মকর্তা নেই সে কারণে এটি শক্তভাবে রক্ষণাবেক্ষণও কঠিন হয়ে পড়েছে। রেকর্ডরুমে অনায়াসেই যাতায়াত করেন পিয়নরা। নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের দিয়ে চলছে রেকর্ডরুমের কার্যক্রম। এতে করে কোনো নিয়ম ছাড়াই চালানো হচ্ছে রেকর্ডরুমের কার্যক্রম। সিলেটে অনেক দলিল বইয়ের বালামের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমন কি নেই ইনডেক্স বুকও। ফলে দলিলের কপি পাওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এসব দলিল না পাওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে- বিভিন্ন সময় ভূমিখেকোরাই টাকার বিনিময়ে বালাম বই ও ইনডেস্ক থেকে কাগজ ছিঁড়ে ফেলছে। এনিয়ে হইচই হয়েছে সাব- রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। নগরীর মীর্জা জাঙ্গালের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমির বালাম পাতা ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে গেল বছর তোলপাড় হয়। রাতের আঁধারে পিয়নরা এসব কাজ করেছিল।
এছাড়া ভূমিখেকোরা টাকার বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট করেও বালাম ও ইনডেক্সের কাগজ সরিয়ে ফেলে। কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এর সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। এদিকে, রেকর্ডরুমে নির্ধারিত কর্মকর্তা না থাকায় সুরক্ষা হচ্ছে না সবকিছু। ধুলোয় ধুসর গোটা রেকর্ডরুম। সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিটি বালাম বই-ই খুবলে খাচ্ছে উইপোকা। একটু ঝাড়া দিলেই উইপোকা ছিটকে পড়ছে। পুরাতন হতে হতে কাগজও ছিঁড়ে পড়ছে এদিক-ওদিক। এসব বালাম বই কিংবা ইনডেক্সের কোনো ডাবল কপি নেই সিলেট জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রারের রেকর্ডরুমে। ফলে কারও দলিল উইপোকায় খেয়ে ফেললে কিংবা চুরি হয়ে গেলেও আর পাওয়া যায় না। সিলেট জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব- রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন অনেকেরই দলিল এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। রেকর্ডরুমের জন্য সরকারিভাবে নিয়োগকৃত পিয়ন প্রয়োজন। এসব পিয়নরাই রেকর্ড কিপারের সঙ্গে কাজ করেন। কিন্তু মাস্টার রোলে থাকা উমেদারদের দিয়ে চালানো হচ্ছে কাজ। এছাড়া, জেলা রেজিস্ট্রারের ৫ তলা ভবনের দু’তলা পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি তিনটি তলাই অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। পূর্বে ওখানে দলিল রাখা হলেও সেটি সরিয়ে পুরাতন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে একদিকে উইপোকার আক্রমণ, অপরদিকে ভূমিখেকো সিন্ডিকেটের থাবায় রেকর্ডরুমে থাকা সিলেটবাসীর সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী বহুল সিলেটে ভূমির দাম আকাশছোঁয়া। এ কারণে ভূমি ব্যবসায় এখানে রাজনৈতিক সিন্ডিকেটরা। বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায় ভূমিখেকো সিন্ডিকেটরাই বেশি সুবিধা নিচ্ছে। এতে করে হারিয়ে যাবে দলিল দস্তাবেজ। বেড়ে যাবে সামাজিক অশান্তি। এমনটি আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেটের সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিকী নিজেই জানিয়েছেন, রেকর্ডরুম সিলেটবাসীর সম্পদ। এখানে সবার সম্পত্তির মূল দলিল রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া দুঃখজনক। এটি সংরক্ষণ করতে বেশি টাকা লাগবে না। সরকারিভাবে সেটি রক্ষণাবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তিনি তার তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবেন বলে জানান। সিলেট সদর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি হাজী মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, রেকর্ডরুমে রেডর্ককিপার ও সংরক্ষণের দাবি দীর্ঘদিনের। দলিল লেখকরা এ নিয়ে সব সময় সোচ্চার। শুধুমাত্র পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের কারণেই জমির বহু মালিক ভোগান্তি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এ জন্য তিনি অর্থমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন। আর দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মইনুল ইসলাম খান সায়েক জানিয়েছেন, রেকর্ডরুম সংরক্ষণ করে রি-ইনডেক্স ও রি-বালাম করার দাবি দীর্ঘদিনের। এছাড়া, একাধিক কপি থাকতে হবে। এতে করে উইপোকায় একটি ধ্বংস হলে যাতে বিকল্প কপি থাকে সে উদ্যোগ খুব দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। নইলে সিলেটবাসীর সম্পদ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাবে।