সিলেটে দানশীল ও বিত্তশালী শব্দের উপমা রাগীব আলীর পাশে কেউ নেই
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০১৬, ১২:০৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেট দানশীল ও বিত্তশালী শব্দের উপমা হয়ে ওঠেছিল রাগীব আলী নামটি। নিজস্ব অনুসারী ও শুভাকাঙ্খীদের কাছে শেষ নেই তার বিশেষণের। কারো কাছে তিনি দানবীর, কারো কাছে শিল্পপতি। জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ থাকলেও রাগীব আলী নিজেকে পরিচয় দিতেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে। ‘উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দানবীর’ দাবি করে শুভাকাঙ্খীরা দীর্ঘদিন ধরে তাকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করারও দাবি জানিয়ে এসেছেন। রাগীব আলী মামলার জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সেইসব ঘনিষ্টজন, শুভাকাঙ্খী নিজের গা বাঁচাতে পিছটান দিয়েছেন। তার চরম দুর্দিনে কেউ নেই তার পাশে। যাদেরকে বছরের পর বছর নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাদের কেউই এখন রাগীব আলীর পাশে নেই। যারা রাষ্ট্রীয় পদক দেয়ার জন্য তার হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, তারা মামলার প্রতিবাদ কিংবা তার কারাবরণের বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটিও করেননি। সব থাকা স্বত্ত্বেও রাগীব আলী যেন এখন ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম এক সর্দার!
জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সিলেটের তারাপুর চা বাগান দখল সংক্রান্ত দুটি মামলায় রাগীব আলী, তার ছেলে আবদুল হাই, নিকটাত্মীয় মোস্তাক মজিদ কারাগারে রয়েছেন। রাগীব আলীর মেয়ে রুজিনা কাদির ও জামাতা আবদুল কাদির পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারাগারে যাওয়া থেকে বাঁচতে রাগীব আলী ছেলেকে নিয়ে ভারতে পালিয়েছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার তিনি ভারতে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে দেশে এনে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এর আগেই তার ছেলে আবদুল হাই গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি তারাপুর চা বাগানের দখল ছাড়তে এবং এ বাগান দখল সংক্রান্ত দুটি মামলা সক্রিয় করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে কোনঠাসা হতে থাকেন রাগীব আলী। সুসময়ে তার আশপাশে ঘুরঘুর করা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ সবাই দুঃসময়ে সরে যেতে থাকেন তার পাশ থেকে। ক্রমেই একা, অসহায় হয়ে পড়েন তিনি।
রাগীব আলী হঠাৎ করেই তার নামের আগে ‘ডক্টরেট’ ও ‘সৈয়দ’ উপাধি ব্যবহার শুরু করেন। এ নিয়ে জনমনে হাস্যরসের সৃষ্টি হলেও তার চাটুকাররাই তাকে এসব উপাধি ব্যবহারে উৎসাহী করে তুলেন।
‘টাকার কুমির’ রাগীব আলীর টাকা দিয়েই তাকে ‘গণসংবর্ধনা’ প্রদান করা হয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে নগরীর আলিয়া মাঠে ওই সংবর্ধনায় সিলেট আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের সুশীল সমাজের অনেক ব্যক্তি, ‘বিশিষ্ট’ কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সিলেটের বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা ওই সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে রাগীব আলীকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করারও দাবি তুলেছিলেন। সেই উৎসাহীদের কেউই এখন রাগীব আলীর পাশে নেই।
রাগীব আলী তার নিজের নামে, স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের নামে ‘রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ‘রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন একুশে পুরস্কার’সহ বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান করতেন। মোটা অংকের এসব পুরস্কার পেতে রাগীব আলী বন্দনায় মেতেছেন অনেক কবি, সাহিত্যিক, বিশিষ্টজন। পুরস্কার পেয়ে গদগদ হয়ে নতুন উৎসাহে ‘রাগীব বন্দনা’য় মেতেছেন তাদের অনেকেই। রাগীব আলীকে নিয়ে লেখা কয়েকটি বই হচ্ছে- ‘মূল্যায়নের মানদ-ে রাগীব আলী’, ‘মাটি ও মানুষের রাগীব আলী’, ‘রাগীব আলী-কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে’, ‘দানবীর রাগীব আলী নিবেদিত প্রাণের কথা গানে’, ‘রাগীব আলী-এ লিজেন্ড অব সাকসেস’, ‘দানবীর রাগীব আলীর মহান কর্মযজ্ঞের রূপরেখা’ প্রভৃতি। সেসব বইয়ের লেখক ও ‘শুভাকাঙ্খীদের’ কাউকেই রাগীব আলীর বর্তমান দুঃসময়ে পাশে দেখা যাচ্ছে না।
রাগীব আলীর টাকায় সিলেটের অনেকেই হজ্বব্রত পালন করেছেন, অনেকেই বাড়িঘর বানিয়েছেন, নিজ নিজ এলাকায় অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাকে খুশি করতে অসংখ্য পুরস্কারেও তাকে ভূষিত করা হয়েছে। পুরস্কার পেয়ে রাগীব আলীও গুণগ্রাহীদের ‘খুশি’ করতে ভুলেননি। তবে চলমান দুঃসময়ে কারোরই দেখা পাচ্ছেন না রাগীব আলী।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি রাগীব আলীর মালিকানাধীন স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় তাকে নিয়ে একটি সংবাদে নামের আগে উল্লেখ করা হয় ‘সমাজসেবামূলক অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বরেণ্য শিল্পপতি, প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শিল্প সাহিত্য ও সাংবাদিকতার পৃষ্ঠপোষক, মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান রাগীব রাবেয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, দানবীর রাগীব আলী….’। রাগীব আলীর নামের আগে তার মালিকানাধীন পত্রিকা কিংবা ঘনিষ্টজন, শুভাকাঙ্খী, শুভানুধ্যায়ীদের ব্যবহৃত অন্তত ত্রিশটি ‘বিশেষণে’র মধ্যে এ হচ্ছে কয়েকটা মাত্র! রাগীব আলীকে খুশি করতে তাকে নিয়ে যেকোন সংবাদে এসব বিশেষণ ব্যবহার করে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু রাগীব আলী মামলার আসামি হয়ে ফেরারি হওয়া এবং অবশেষে কারাগারে যাওয়ার পর এসব বিশেষণ আর ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।