কাঁঠালচাঁপার আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া প্রহর: (১৭তম খণ্ড)
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০২০, ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ
জাকির মোহাম্মদ:
আমি হারাতে চেয়েছিলাম তোমার মাঝে। শেষ পর্যন্ত সেটি হয়ে উটব কি না জানিনা। তোমাকে বুঝতে পারিনি ফেরদৌসি। জানার বুঝার বাইরে তোমার উড়ালচণ্ডি মন। আর কত দিন উড়াল থাকবে যদি বলতে?
না,তুমি সত্যিই আমাকে বুঝোনি।
আজ বুঝলাম।
যদি আমাকেই বুঝতে তবে এরকম কথা বলতে পারতে না।
কি রকম বলতে হতো বলতো?
বলতে আমাদের বিয়ের প্রিপারেশনের বিষয়ে। জানোই তো পরিবারের বড় মেয়ে। চারদিক থেকে পঙ্গপালের মত বিয়ের কথাবার্তা আসে আব্বা কাছে। এই আজ আব্বার বন্ধুর ছেলে,কাল কলিগের ভাতিজা পরশু দেখা গেল শুভাকাঙ্ক্ষির শ্যালক। আমাকে বাজারে মাছরর ঢালার মধ্যে নিয়ে রীতিমত খেলা চলছে। সে খেলায় একলা একজন আমি সামাল দিতে পারছি না। একটু সহযোগিতা কি করবে না।
বাপরে!
একেবারেই সিরিয়াস হয়ে গেলে।
পঙ্গপালের এত আক্রমন যখন কিটনাশক ছিটিয়ে গলায় ঝুলে পড়ো। পরিবারকে মুক্তি দিলে। আর নিজেও শান্তি হলে।
কাজলের হাতের মুঠোভরা আঙুল ক্রমশ আলাদা হতে লাগলো। সত্যি কী তোমার এই মতামত?
মতামত কি না জানি না কিন্তু পরামর্শ হতেই পারে। দেখো আমার সিরিয়াল কমপক্ষে পাঁচ বছর পরে। তোমার গলায় লাগানো স্বর্ণের বেড়ি। কি করি,কি করতে পারি। তার সাথে নেই কোন জব। কী দিয়ে দাঁড়াবো? চাইলেই কী পারা যায়?
কি পারা যায় বলো। না। সব বলতে পারিনা বলেই তো আজকাল কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। মনে করতে পারো কতদিন পর আজ দেখা?
কতদিন পর আজ কথা হচ্ছে।
এত ইগোর সাথে বসবাস হয়না। তবুও সুযোগ আর চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। প্রতিদিন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছি?
তুমি?
এটি বলছো!
বিস্ময়ের কি আছে। আমার নিজের জন্য চলতি পথে জবের কী প্রয়োজন নেই। তোমাদের এই অবিশ্বাসের চাহনি না নিতে পারি না। বিশ্বাস করো, বাস্তববাদী হবার চেষ্টার কোন ত্রুটি করছি না,রাখছি না।
সে কেবল আমার কাছে এলে।
দূরে গেলে কী করো তা তো দেখি। করতে পারো এক আড্ডার বেশাতি। আর কিচ্ছু না কিচ্ছু না।
এটিই শুধু দেখলে।
অন্যকে দেখিয়ে কাজ করার গুন আয়ত্ব করা নেই। আসলে পারিও না। এই দেখোনা যা হচ্ছে যা করছি সব কেমন হড়হড় করে বলে যাচ্ছি। জানিনা, তোমাকে সেটি বুঝাতে পারছি কি না?
সত্যিকার অর্থে পারছি না,পারি না। কারণ আমার কথায় রঙ নেই,ঢঙ নেই। রঙ ঢং ছাড়া কথা বুঝানো কঠিন?
তোমার এই গুনটিই আমাকে মেরেছে। এখানেই বন্ধি হয়ে গেছি আইলার ঘূর্ণিঝড়ের মত আবহাওয়া নিয়ে। যদি বাঁচতেই হয,তোমাকে নিয়ে বাঁচার লড়াই করতে চাই।
তুমি বড্ড পাগল ফেরদৌসি?
আইলার তাণ্ডবলীলা বেশ কার্যকর না জানোই তো। তুমি আমাকে নিয়ে সত্যি বেশিদূরে যেতে পারবে না।
একটু তো যেতে পারবো।
আমি সেটুকুতেই শান্তি।
তোমাকে স্বস্তি দিতে পারি,কিন্তু কখনো শান্তি দিতে পারি না। কেন পারি না তা জানা নেই?
জানার চেষ্টা করো না, কেমনে জানবে?
বকুল উঁকি দেয়। মিষ্টি হাসির সাথে জানতে চায় কতদূর? আর সময় দেয়া যাবে না। ফিরতে হবে? অফিসের সময়ও শেষ হচ্ছে।
বৌদির ননদকে নিয়ে একটু আগেই বিদায় নিয়েছেন। আমরাও উটবো উটবো ভাবছি। কিন্তু চাইলেইতো আর পারা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টি যেন একেবারে অলস করে দিয়েছে।
আজ বাইরে কোথাও বসার খুব ইচ্ছে ছিল। কোথায় যাবো যাবো করে আমরা রাজনগরের দিকে ছুটলাম। এখানেও একটি কাঁঠালচাঁপা গাছের নীচে বসলাম। কিছু ছবি তুললাম। একটা কাঁঠালচাঁপা ফুল মোমবাতির উপর উপুড় হয়ে পড়েছে সেই দৃশ্যে আটকে গেলাম। পাশেই একটি জারুল গাছে নীল-বেগুনি ফুলের সমাহার আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। গাছটির সাথে হেলান দিয়ে আমরা ছবি তুলি। বকুল একের পর এক ছবি তুলে আর নানা জাতের কথা বলে।
এই!
একটুর জন্য তো পড়েই গিয়েছিলে?
তোমরা দুজন থাকতে পড়ে যাবো সে বিশ্বাস আমার ছিলো না তাই পড়া হলো না।
গুড,গুড।
এরকম হলেই না আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
হাহাহা
তোর আত্মবিশ্বাস তো আমার থেকেও বেশি কেমনে এই কিছুক্ষণের আলোচনায় সব ভেস্তে গেল।
এবার ফেরদৌসির চেহারায় আমার দিকে বড় চোখে চাইবার অবস্থা দেখা গেল।
আড়চোখে চাইলাম আর বকুলের কথার ফিরতি ছাড়বো এমন সময় স্প্রেডব্রেকার গাড়ির দিকে নজর পড়লো। গাড়ি খালি পড়ে আছে। কিছুদিন আগে দূর্ঘটনার জন্য হয়তো এখন খালি। পাহাড় বেয়ে আমরা টিলায় পৌঁছলাম। বিকেলের আমাজে চারদিকে সূর্য দেখার মত। আর কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়া সে সৌন্দর্য অনেকগুন বেড়ে গেছে। সাথে ফেরদৌসি আছে। সবকিছু মিলিয়ে এ অভাবনীয় সৌন্দর্যরূপ দেখে কবি হবার বাসনা জাগলো। কিন্তু কবি হবার দায় নেই একেবারেই। বরং কবিতা আবৃত্তি শুনতে পারি।
তাকিয়ে দেখি ফেরদৌসির উদাস দৃষ্টি চা বাগানের ভেতর কোন সুদূরে খেলা করছে তার কোন ঠিক নেই। না। আমি এই তন্ময়তা আর ভাঙ্গিনি।
কিছু দূরে বকুল প্রজাপতির ছবি তুলছিল। সেদিকে গেলাম। ছবি তুলতে চেষ্টা করছি আমিও। কিন্তু সূর্যের কারণে ছবিতে অতিরিক্ত কালার চলে আসায়, আর ছবির দিকে মনযোগি হতে পারিনি।
খুব জোর দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক’র জোছনা রাত কবিতার তিন লাইন ফেরদৌসির ঠোঁটে নেচে উঠলো…
‘সে রাত ছিল জোছনা ভরা সে রাত ছিল দুগ্ধের
মাঠের বুকে লম্বা ছায়া
মূর্খ এবং মুগ্ধের’
এই কবিতাটা এই প্রথম আবৃত্তির ঢঙে কারো কাছে শুনলাম। আমার ভালো লাগলো। আরও ভালো লাগতো যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে ডুবে থাকতে পারতাম। আসলে পারা যায় না।
আজকের মত বিদায় নিতে হবে। বকুল সি এন জি ডাকছে। রিক্সা করে যাবে ফেরদৌসি। লাল ওড়নার আঁচলটা যে শিমুল তুলোর মত উড়ে উড়ে যাচ্ছে। হয়তো আমার মনটাও ঠিক এমন করে উড়ছে…চলবে।