কাঁঠালচাঁপার আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া প্রহর (১৬ তম খণ্ড)
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২০, ৮:৩৪ অপরাহ্ণ
জাকির মোহাম্মদ:
বকুলের সাথে কথা বলার পর ফেরদৌসি ঠিক করেছিল দেখা করা যাবে, তবে সময় বেশি দেয়া যাবে না। অফিসে যেখানে কাজ করে সে তার সহকর্মী আরও দুজন ছিলেন একজনের বাড়িতে কী এক অসুবিধার জন্য আসবেন না আর আরেকজন এসেই চলে যাবেন,শহরে কাজ আছে। সো,দেখা করা যেতে পারে।
সকলটা শুরু হলো এক হইচইয়ের মধ্য দিয়ে। পাশের কলোনিতে আগুন লেগেছে। অনেকগুলি ঘর পুড়ে ছাই। কেন কিভাবে আগুন লাগলো কেউ কিছু বলতে পারলো না,কেবল মুরব্বী মহিলা একজন বললেন এক ছোট ছেলে দিয়াশলাই দিয়ে খেলছিল একটু আগে। মনে মনে ভাবলাম খেলতেই পারে। ভোরে মায়ের সাথে উঠে রান্নাবানার কাজে মা হয়তো অন্য মনস্ক হওয়াতে বাচ্চার হাতে দিয়াশলাই এসে গেছে। বকুল চোখ টিপে দিল। বুঝলাম গাফলা আছে,থাক বাবা আমাদের খেয়ে কাজ নেই। যার যা তার গেছে। কলোনীর ভাড়াটিয়া চ্যাঞ্জ করতে নিজের কলোনীতে নিজেই আগুন দেবে। কী গ্রাম,কী শহর, কী রাজধানি। কলোনীর কথা আসলেই হঠাৎ আগুন দাউ দাউ করে জ্বলার দৃশ্য ভাসবেই চোখে। আজও সেটি স্পষ্ট হল।
আগুন,কলোনী আর মানুষের চিন্তার জগত পরিবর্তন আনতেই হবে। এ পরিবর্তন না আনতে পারলে জাতি হিসেবে আমাদের অনেক ভোগতে হবে। এটি যেমন আজ তেমনি পরের দিনেরও চিন্তা। আমাদের চারপাশের পরিকল্পনার অভাব থাকে না,দেখা যাচ্ছে সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলেই সমস্যা। কলোনীর ভাড়াটিয়া সমস্যা সেটি বসেও সমাধান করা যেতো। কিন্তু কেন গেল না তারও হয়তো কোন কারণ আছে। যাদের সাথে বসবে তারা কী সে সুযোগ দিবে। কী পরিমান চিল্লানি হয় বসতে গেলে,কথা বলতে গেলে সে কী আর নতুন কিছু? এজন্যই কী সমাধান হলো আগুন?
এই হইচই যা শুরু হয়েছে সেটি সারাদিনেও যে শেষ হবে না সেরকমটি ভাবা যেতে পারে। হয়তো রাতে বাসায় ফিরে এসে এই চিল্লানির কিছু না কিছু রেশ পাবো। দেখা যাক।
বাসা থেকে বের হয়েই শামসাদকে পেয়ে গেলাম। বাপরে চুলের যে স্টাইল।
অয় বন্ধু,তোর খবর কি?
কি খবর বলবো, তোর তো দেখা নেই। একেবারে লাপাত্তা?
মনে হচ্ছে অন্য কিছুর ধান্ধায় মজে গেছিস?
না রে বন্ধু,মজামজি না আছি টিউশনি নিয়ে। তোদের তো টিউশনি করা লাগে না বুঝবি কি?
বাহ! কথার কি ভাব।
বকুল বললো আচ্ছা পিরিতের কথা আর না,চলো সময় নষ্ট হচ্ছে। টান পায়ে পা ফেলো।
শামসাদকে এখানেই বিদায় দিতে হলো। সে তার মেচের পাশেও এসে গেছে।
আমরা মেজরটিলায় সিএনজি ধরলাম। সেখান থেকে বন্ধর। তারপর কদমতলি। এখান থেকেই আমাদের গন্তব্যের বাস। সিট মিললো একটি। দেরি করা যাবে না,এক সিটেই ভাগাভাগি করে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। পানি আর কিছু চানাচুর হাতে নিয়ে বকুল ফিরলো।
বসন্তের শেষ সময়। তখন বৃষ্টির অগোছালো ঝাপটা প্রকৃতিতে পড়তে শুরু করেছে। আর জমিন যেন সবুজ শাড়ি পড়ে একেবারে নববঁধুর মত সেজে আছে। এদিকটায় গত রাতে বৃষ্টি হবার লক্ষণ স্পষ্ট। ব্যাঙগুলি ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করে যাচ্ছে অবিরত। ফেরদৌসির হাসির স্বাগত সাথে ব্যাঙ যে প্রাকৃতিক ভাবে আমাদের বরণ করে নিচ্চে সেদিকে ইঙ্গিত। তার বান্ধবী একটা এসেছে। প্রভার মুখে মেজ বৌদির প্রশংসা শুনে বললাম বৌদিকে না দেখে যাচ্ছি না। ডাক দাও।
আমাদের কথা এগুচ্ছিলো আর নাস্তার প্রাথমিক পর্বটা সারা হচ্ছিলো,ঠিক তখন দরোজায় দাঁড়িয়ে বৌদি। আদাব দিলাম সবার আগে। কুশল জিজ্ঞেস করেই জানতে পারলাম বৌদি কেবল বৌদিই তো নন,ননদদের অত্যন্ত কাছেরজনও তিনি। প্রথম দেখা,কিন্তু কোন ভাবেই মনে হলো না আজই দেখা হয়েছে। স্বজ্জন মানুষ এরকমই হয়তো হোন,অনন্ত বৌদিকে দেখে সেটি ভাবতেই পারি।
ফেরদৌসির সাথে কথা বলতে দিয়ে তারা রীতিমতো আলাদা আড্ডায় মজে গেল। কি ব্যাপার আমার সাথে ফোন করার কোন সময় থাকে না। এটি কেমন করে হয়?
কেন হয় না।
হতে তো পারে।
সামনে পরিক্ষা এখন ফোনে সময় নষ্ট করার কোন মানে আছে।
সময় নষ্ট হয়,হু।
তার কৌতুহল আরেকটু বাড়লো মনে হয়। বললো সময় নষ্ট হয় বলে ফোন করো না, করো কী তখন?
কেন পড়ি?
স্টাডি করো তুমি?
কেন আমার স্টাডির দরকার হয় না।
হু,গুড গুড।
কি করবে এত পড়ে?
হয়তো কিছু করতেও পারি,আর সবে করে। আমি একজন না হয় কিছু না করলাম।
কাজল,এই হেয়ালি রাখেন তো। সবকিছুতেই হেয়ালি ভালো লাগে না।
কি ভালো লাগে?
হাতটা ধরি?
না,ধরবে কেন?
এখানে হাতটা ধরলে কী এমন ক্ষতি হবে শুনি।
না বৌদি আছেন তো?
তাতে সমস্যা কি?
কথাবার্তা তো দারুন। খইফুটে যেন। বৌদি পাইছো। সেই।
আর বৌদির ননদ?
পঁচা বল সাবান।
সত্যি?
হাহাহা বৌদিকে জিজ্ঞেস করে এসো?
না না। আমার দ্বারা সেটি হবে না। বৌদির মুখে এমনিতেই কিছু আটকায় না। এত লাগাম ছাড়া বলনি তো আগে?
কখন জানবে?
সে সময় আছে?
নাই বা হল কখন?
নির্দিষ্ট সময় তো কথা হচ্ছেই।
আমার না, মিছামিছি বিষয় কথা বলতে ভালো লাগে না।
কী মিছামিছি।
এই যে আমি ক্যাম্পাসে আছি,তোমাকে বলতে পারবো না বাসায়। এটি কি আমার সমস্যা।
না তোমার সমস্যা না কিন্তু ক্যাম্পাসে, আড্ডায় এত সময় দিবে,তো আমার সময় কই?
এখানে আসলেই দুনিয়ার ব্যাস্ততা বেগ পায়। সিনেমা দেখার সময় নষ্ট। বাইরে যাবার সময় নষ্ট?
আজকি কেবল অভিযোগেই সময় পার হবে?
তোমার সাথে বসলে অভিযোগহীন সময় আমার হয়েছে?
কি বলো আমাদের সময় কী একেবারেই আনন্দহীন গেলে।
না না সেটি তো বলছি না। বলছি,আমার প্রতি এক ধরনের উদাসিনতা আছে তোমার।
এরই মধ্যে বৃষ্টি নামলো ঝুম করে। বৌদি বাসায় দিলেন দৌড়। প্রভা আর বকুল বসে আছে। হাসাহাসি করছে খুব। দেখে অনেক সুন্দর লাগছে। আমি সেদিকে চেয়ে আছি।
বৃষ্টির দিকে মুখ করে ফেরদৌসি গুনগুন করছে। বললাম কি করো।
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা মনে পড়ছে?
‘নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকার কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুন মেঘের তুচ্ছ,
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেনড্রনগুচ্ছ।
এইখানে বলতেই পারি,ফেরদৌসির কবিতা আবৃত্তির এই অসম্ভব সুন্দর কৌশলে যেন আরেকবার আমি হারিয়ে গেলাম। তার লম্বা চুলের রেশমি দোলা বারবার চোখের উপর পড়ছে, অথবা সে একটু অন্যমনস্ক থাকার কারনে তার মধ্যে যে ক্লান্তি এসেছে সেই দৃশ্যটা যে কি সুন্দর তার বর্ণনা দিতে পারছি না। এই ভাবনার কালে সে হাতে আবার টান দিলো। কী ব্যাপার কই হারালে?…চলবে