বাংলা ভাষায় কুরআনুল কারিমের সহজ তরজমা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মার্চ ২০২০, ৪:৪২ অপরাহ্ণ
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল:
মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াতি কাজ পৌঁছে দেওয়ার জন্য হেকমত অবলম্বন ও উত্তম ব্যবহারের পাশাপাশি মূলত দু’টি পদ্ধতি বেশি কার্যকর। তার মধ্যে একটি হলো বক্তৃতা, আর অন্যটি হলো লেখনী। আর লেখালেখির কাজ হচ্ছে মেধা, যোগ্যতা এবং পরিশ্রমের। বর্তমানে দেশ বিদেশে বাংলাভাষী পাঠকদের সামনে কুরআন-সুন্নাহর দাওয়াত লেখালেখির মাধ্যমে যারা তুলে ধরছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শায়খ শফিকুর রহমান আল-মাদানী। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল আলেম, লেখক ও গবেষক। দীর্ঘ তিন দশক থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন সপরিবারে। পাশাপাশি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুধী মহলে লাভ করেছেন আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা। দেশ-বিদেশে আলেম সমাজ, মুসলিম স্কলারদের সঙ্গে রয়েছে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। সজন সুজন এবং পরিচিত মহলের কাছে তিনি বিশ্বস্ত ও প্রীতিময় এক সুহৃদ।
শায়খ শফিকুর রহমান ১ মার্চ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার আলীমপুর (কুমার সাহিল) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে ১১ বছর বয়সে সম্পূর্ণ কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশে মাস্টার্স স্তরের শিক্ষা (মাদ্রাসা শিক্ষা, ১৯৭৯ খ্রি.) সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে সৌদি আরবের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মদিনা থেকে উচ্চতর ইসলামিক শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ লাভ করেন। ডিসেম্বর ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মদিনা মনোয়ারা গমন করেন এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ মদিনার ফ্যাকাল্টি অফ কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ (১৯৮৪, ১৪০৪ হিজরি) থেকে কুরআনিক সাইন্সেস (উলুম আল কুরআন) বিষয়ে আরেকটি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তাঁকে যুক্তরাজ্যস্থ সৌদি এনজিও দারুল ইফতায় একজন দাঈ ও শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি যুক্তরাজ্যের একজন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক (পিজিসিই, ১৯৯০ খ্রি.)। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বই দশকের প্রথম কয়েক বছর তিনি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন মুসলিম স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষে তিনি পূর্বেকার ওয়েস্ট লন্ডন ইনস্টিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, বর্তমানে ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি থেকে সাফল্যের সাথে পোস্ট গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (পিজিসিই) সম্পন্ন করে ইউকে কোয়ালিফায়েড টিচার স্টেটাস (কিউ টি এস) অর্জন করেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দারুল ইফতা থেকে ইস্তফা দিয়ে এবং শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ইউকে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়)-এ একজন চ্যাপলেইন (ধর্মীয় উপদেষ্টা/পরামর্শক) হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডিúেøামা ইন ম্যানেজমেন্ট সম্পন্ন করে একজন ম্যানেজার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। শায়খ শফিকুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবে ইসলামিক দাওয়া বিষয়ক কর্মকা-ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকে দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে অ্যান্ড আয়ার-এর সাথে তাঁর দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ সম্পর্ক রয়েছে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে তিনি দাওয়াতুল ইসলাম লন্ডন মেট্রোপলিটন সিটি-এর সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে অ্যান্ড আয়ার-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে অ্যান্ড আয়ার-এর আমির হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামিক শরিয়াহ কাউন্সিলের একজন সদস্য। কুরআনে হাফেজ শায়খ শফিকুর রহমান আল মাদানী শৈশব থেকেই অসাধারণ মেধাবী। তাঁর বাংলা ভাষায় কুরআনের সহজ তরজমা আসলেই সাধারণের ভাষায় এক অনবদ্য সহজ সরল অনুবাদ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি পাতায় বাংলা ভাষা অত্যন্ত সহজ সাবলীল। তাঁর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা এবং স্বার্থক শব্দ চয়নে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের একজন পাঠক হিসেবে খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়া’লার এক বিরাট অনুগ্রহ হলো, তিনি মানুষকে ‘বলে’ এবং ‘লিখে’ মনের ভাব প্রকাশ করার যোগ্যতা দিয়েছেন। তাই তো মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘আল্লামাহুল বায়ান’ অর্থাৎ তিনি মানুষকে বলতে শিখিয়েছেন এবং ‘আল্লামা বিল কালাম’ তিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। বয়ান বা বক্তৃতার মাধ্যমটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক ও ক্ষণস্থায়ী। আর লেখনীর মাধ্যমটি বিস্তৃত সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইসলামের মহান বাণীর ব্যাপক প্রচার প্রসার ও দাওয়াত-তাবলীগের কাজে লেখনীর গুরুত্ব অপরিসীম।
যারাই আল্লাহর কুরআন বা কুরআনের কিছু হলেও শিখেছেন, বুঝেছেন, তাদের কর্তব্য হলোÑনিজেরা তা মেনে চলবে এবং অন্যদের তা শেখানো, বুঝানো এবং মেনে চলার জন্য আহবান জানানো। মৌখিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করা তো সবারই দায়িত্ব। কিন্তু আল্লাহ তায়া’লা যাদের লেখার যোগ্যতা দান করেছেন, এ দায়িত্ব পালনে কলম ধরাও তাদের কর্তব্য। ইসলামের খেদমতে, দ্বীনের প্রচার-প্রসারে লেখনী একটি শক্তিশালী মাধ্যম। লেখনী মানুষের মনে নীরবে-নিভৃতে প্রভাব বিস্তার করে। লেখা মানুষের সাথে একান্তে কথা বলে এবং অন্তরে অভূতপূূর্ব বিপ্লব সৃষ্টি করে। এ কারণেই তো দেখা যায়, অনেক সময় অনেক কথা বলেও যাকে কাজে জুড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সে সংক্রান্ত একটা লেখা তার হাতে আসার পর সে নিজ থেকে সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছে এবং সে আমলে বা কাজে মনোনিবেশ করছে। এ রকম হাজারো দৃষ্টান্ত আছে। তাই ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বক্তৃতার পাশাপাশি লেখনীর খেদমতে ব্যাপকভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া সময়ের অন্যতম দাবি। সাহিত্যের চরম বিপ্লবের যুগে ইসলাম প্রচারে লেখনী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দুনিয়াতে আল্লাহর পথে আহবানের জন্যই নবী-রাসুলদের আগমন। আর এ কারণেই একজন মুমিনের জীবনের অন্যতম মিশন হলো মানুষের প্রতি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া। নিজেদের জীবনে কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধান বাস্তবায়নের পাশাপাশি পরিবার ও পার্শ্ববর্তীদেরকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহবান করা মুমিন বান্দার আবশ্যক কর্তব্য। এ কারণে আল্লাহ তায়া’লা কুরআনুল কারিমে মুমিনদের একটি বড় দায়িত্বের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ন্যায় কাজের আদেশ দেওয়া এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা।’ ন্যায় কাজে আদেশ এবং অন্যায় কাজে নিষেধকে একত্রে বুঝায় ‘আল্লাহর পথে আহবান’। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়া’লা এ দাওয়াতের নির্দেশনা দিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষায় এ দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। কোথাও সরাসরি দাওয়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোথাও সৎকাজের আদেশের কথা বলা হয়েছে; কোথাও অসৎ কাজের নিষেধ করেছেন। আর দ্বীন প্রতিষ্ঠা, প্রচার, তাবলীগ, নসিহত ও ওয়াজ বলেও দাওয়াতকে অভিহিত করা হয়েছে। দাওয়াতকে যে নামেই বুঝানো হোক; মানুষের প্রতি দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোও আবশ্যক করণীয় ইবাদত। আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে লক্ষ্য বলে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে নিজে বাঁচ এবং তোমার আহল বা পরিবার-পরিজনকে বাঁচাও।’
মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া হলো নবুয়তি কাজ। নবুয়তি কাজের আঞ্জাম দেওয়া মুমিন মুসলমানের জন্য আবশ্যকীয় কাজ। সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, তাবলীগ, প্রচার, নসিহত ও ওয়াজ করা ছিল নবী-রাসুলদের ওপর ফরজ দায়িত্ব। এ কারণে সব নবী-রাসুলই তাঁর উম্মতকে তাওহীদ ও ইবাদতের আদেশ করেছেন। র্শিক, কুফর ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে রাসুল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে (কুরআনের বিধিনিষেধ) তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তবে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না।’ (সুরা আল-মায়িদাহ : ৬৭)
আয়াতে বুঝা গেল আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতের প্রচারই ছিল নবী-রাসুলদের প্রধান দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘রাসুলগণের দায়িত্ব তো শুধু সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা।’ (সুরা আন-নাহল : ৩৫)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার প্রতিপালকের (পক্ষ থেকে) রিসালাতের দায়িত্ব তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদেরকে (দ্বীনের) নসিহত করছি।’ (সুরা আল-আরাফ : ৬২)
ইসলামের বিধিবিধানের এ দাওয়াতি মিশন পালনের বর্তমান দায়িত্ব হচ্ছে মুমিন মুসলমান, আলেম-ওলামাদের ওপর। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলতা লাভ করবে। আর দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, নসিহত ও ওয়াজ করা হলো উম্মতে মুহাম্মাদির অন্যতম দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়া’লা এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কুরআনে উল্লেখ করেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।’ (সুরা আলে-ইমরান : ১০৪)
আল্লাহ তায়া’লা মুসলিম জাতিকে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণে) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ কর এবং আল্লাহকে বিশ্বাস কর।’ (সুরা আলে-ইমরান : ১১০)
পরিশেষে মানুষের প্রতি দাওয়াত দেওয়া মুমিন মুসলমানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব পালনে নবী-রাসুলদের ওয়ারিশ মুসলমানকেই এগিয়ে আসতে হবে। কুরআনের নির্দেশনাও তাই। আল্লাহ তায়া’লা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক