টাঙ্গুয়ার হাওরে দিন দিন কমছে পাখি, থামছে না শিকারও
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ১২:৫১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
প্রতি বছর শীতের শুরুতে মাদার ফিসারিজ রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওরে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসতো। বিভিন্ন ধরনের কলকাকলিতে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে উঠত পুরো হাওর এলাকা। তবে এবার খুব একটা অতিথি পাখি দেখা যাচ্ছে না। এতে টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। এবার আশানুরূপ পাখি না আসার কারণ হিসেবে হাওরের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে শীত শুরু হলেই মৌলভীহাঁস, বালিহাঁস, লেঞ্জা, চোখাচোখি, বেগুনি কালেম প্রভৃতি অতিথি পাখি আসত। গত কয়েক বছর ধরে অর্থের লোভে শিকারিরা প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের কারেন্ট জাল ও ফাঁদ দিয়ে পাখি শিকার করছে। ফলে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখিরাও আসছে কম।
এদিকে টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা সত্ত্বেও প্রতিদিনই দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক পাখি দেখতে হাজির হচ্ছে। তবে হাওরে এসে তাদের হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হতে হচ্ছে। কাঙ্খিত পাখির দেখা মিলছে না। ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ, পাখির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পর্যটকরা। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোসহ এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওর ১০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। তুষারপাত ও শৈত্যপ্রবাহ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে প্রতি বছর শীতের শুরু থেকেই সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে থাকে। এসেই প্রথমে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও প্রচুর খাবারসমৃদ্ধ হাওরে বিচরণ করে তারা যেন সজীবতা ফিরে পায়। এদের মাছ শিকার, শামুক খাওয়া, জলকেলি, খুনসুটি আর কিচিরমিচির কলতানে পুরো হাওর জুড়ে র্স্বগীয় পরিবেশে সৃষ্টি হয়। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এখানকার মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। এখানে বেড়াতে আসা পাখিপ্রেমী পর্যটকদের সহজেই নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে। তবে এবার এর ছিটেফোঁটাও মিলছে না। হাওরের কোনো রূপই দেখতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন হাওর পাড়ের বাসিন্দা ও পর্যটকরা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে এক হাজার আটশ ৫৫ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখির বিচরণ ছিল। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতির পরাযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি বিচরণ করত।
এদিকে ২০১১ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিভিন্ন বিলে পাখি শুমারিতে প্রায় ৬৪ হাজার পাখি পাওয়া যায়। এতে ৮৬ জাতের দেশি ও ৮৩ জাতের বিদেশি রয়েছে। এখন এ সংখ্যা অনেক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদ ও টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা।
এর কারণ হিসাবে জানা যায়, রাতের আঁধারে এক শ্রেণির অসাধু পাখি শিকারি ও ব্যবসায়ীরা জলাবন, হিজল কড়চ, নলখাগড়া ইঞ্জিনের নৌকায় করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খামারিরা হাঁসের পাল হাওরে নিয়ে পাখির খাবার খাওয়াচ্ছে, মাছ ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে আনসার বাহিনীদের সহযোগীতায় মাছ ও অতিথি পাখি শিকার করছে। এসব কারণে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে স্থানীয় হাওর পাড়ের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করছেন।
তাদের আরো অভিযোগ, এসব অনিয়ম প্রতিরোধে হাওরের দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনার আগেই মাছ শিকারিদের জানিয়ে দেয় আনসার সদস্যরা। এতে অভিযান ব্যর্থ হয়। ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য ও সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে আসা তাহিরপুর উপজেলার সাদেক আলী ও রফিকুল ইসলাম জানান, রাতে ঘুমানোর আগে পাখিদের উড়ার শো শো শব্দের আওয়াজ এখন আর কানে আসে না। এখন পাখি অনেক কমে গেছে। আর যোগাযোগ ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না থাকার কারণে পর্যটকদের আনাগোনাও কমে গেছে।
এছাড়া মেহেদী হাসান ভূঁইয়া নামে অপর এক পর্যটক জানান, আগেও দু-একবার এসেছিলাম। তবে এবার পাখি নেই বললেই চলে। টাঙ্গুয়ার হাওরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন কার্যকর, জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না বাড়ালে পর্যটকরা আরো মুখ ফিরিয়ে নেবে।
তাহিরপুরের ইউএনও বিজেন ব্যানার্জি জানান, অবৈধভাবে পাখি ও মাছ শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর হাওরে কোথায় কোথায় পাখি শিকার, বিক্রয় হচ্ছে এবং কিভাবে পাখি পাচার হচ্ছে- এসব তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয়রা জানালে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।