সিলেটে অস্বাভাবিক গৃহকর নিয়ে হইচই
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মে ২০২৪, ৮:১০ অপরাহ্ণ
মুকিত রহমানীঃ
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) হোল্ডিং ট্যাক্স বা গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন (রি-অ্যাসেসমেন্ট) শেষে কর ধার্য করে দুই বছর আগে পরিষদে পাস করিয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তাঁর সময়ে ২৭টি ওয়ার্ডের ৭৫ হাজার ৪৩০টি গৃহ থেকে ১১৩ কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার টাকা কর আদায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। নতুন গৃহকর ধার্যের সময় ধরা হয় ২০২১-২২ অর্থবছর। মেয়র আরিফ নতুন করের বিষয়টি প্রকাশ করেননি, বাস্তবায়নও শুরু করে যাননি।
নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় গত এপ্রিলে নতুন করের বিষয়টি প্রকাশ করেন। তাঁর পরিষদ নগর ভবনের সামনে ৩০ এপ্রিল থেকে ‘হোল্ডিং ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট’ ক্যাম্প শুরু করে। এতে শুরু হয় হইচই। গৃহ মালিকদের অনেকেরই করের পরিমাণ দেখে চোখ ছানাবড়া। যাঁর ৩০০ টাকা বার্ষিক কর ছিল তাঁর এখন ৩০ হাজার টাকা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকশ গুণ বাড়ানো হয়েছে গৃহকর। এতে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন গৃহ মালিকসহ বিভিন্ন পেশার নাগরিকরা। তারা নতুন কর বাতিলের দাবি তুলে স্মারকলিপি দেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অস্বাভাবিক গৃহকরের জন্য কারা দায়ী, নাগরিক না নগর ভবন। রাজস্ব কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক গৃহ মালিক কর ফাঁকি দিয়েছিলেন। এখন নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করায় তাদের পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য মালিকরা দায়ী। আবার গৃহ মালিদের দাবি– আয় নেই, এমন ভবন মালিকসহ অনেকেরই ২০ থেকে ২০০ গুণ পর্যন্ত কর বাড়ানো হয়েছে, যা অযৌক্তিক বোঝা।
নতুন কর নিয়ে নগরবাসী প্রতিবাদমুখর হওয়ায় গতকাল রোববার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান। তিনি নগর ভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নগরবাসীর অভিভাবক আমি। তাদের ওপর কোনো বোঝা হবে– সেটা চাই না। তাই নতুন কর আদায়ের আগে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা হবে। আগামী ২৮ মে পর্যন্ত ২৭টি আপিল বোর্ড কাজ করবে। ভবন মালিকরা ২৮ মে পর্যন্ত করের হার পুনর্মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবেন।’ তিনি আরও জানান, নতুন ১৫টি ওয়ার্ডের নাগরিকরা করের আওতায় পড়বেন না। পুরোনো ২৭ ওয়ার্ডের ট্যাক্সের কার্যক্রম চলমান থাকবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে রিভিউ বোর্ডে একজন করে প্রকৌশলী ও আইনজীবী থাকবেন। রিভিউ বোর্ডকে নিজে মনিটর করবেন বলে জানান মেয়র। কয়েকশ গুণ কর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, এমন ব্যক্তি রয়েছেন, যার ক্ষমতা রয়েছে ৫০ হাজার টাকা কর দেওয়ার, অথচ তিনি দিচ্ছেন ৫ হাজার টাকা। নতুন হিসাব করে তাঁর করের পরিমাণ গিয়ে হয়তো দাঁড়িয়েছে ৮০-৯০ হাজার টাকায়। কিন্তু সেটা তিনি কয়েকশ গুণ বলে দাবি করছেন। বাস্তবে তাঁর কর ফাঁকির কারণে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গৃহ ও ভবন মালিকদের ওপর আরোপিত কর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৭৫ হাজার গৃহের মধ্যে অধিকাংশ মালিকের কর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করা হয়েছে। টিনশেড বাসা বা দোকান থেকে প্রতি বর্গফুট ৫ টাকা ও দালানের ক্ষেত্রে ১০ টাকা করে কর দুই বছর আগে ধার্য করা হয়। নতুন করের তালিকায় দেখা গেছে, নগরীর ধোপাদীঘির পাড়ের বাসিন্দা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বাসার কর আগে ছিল ২০ হাজার টাকা; তা করা হয়েছে ৯৫ হাজার টাকা। নগরীর বিলপাড় এলাকার বাড়ির মালিক পংকি মিয়া আগে বছরে কর দিতেন ৪০০ টাকা; এখন করা হয়েছে ২ হাজার ৮০৮ টাকা। তিনি আপত্তি ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন। দেখা গেছে, দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়ার চার তলা ভবন মালিক প্রয়াত আবদুল গফুরের ১২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে একটি বাদে সব ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আগে তাঁর পরিবার ৬০০ টাকা গৃহকর দিলেও এখন ধার্য করা হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬০০ টাকা। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কামাল আহমদ তাঁর দুই দোকানের কর আগে দিতেন ৫০০ টাকা। এখন করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। ২১ নম্বর ওয়ার্ডের পিন্টু চন্দ্র দাসের বছরে কর ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা; তা করা হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা।
নতুন করের তালিকা প্রকাশের পর ভবন মালিক ছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোকজন প্রতিবাদ শুরু করে। সর্বশেষ গতকাল মেয়রের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে কর প্রত্যাহার দাবি করেছে সিলেট কল্যাণ সংস্থা (সিকস), বিএনপি, জামায়াত, এনডিএফ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাসদসহ বিভিন্ন সংগঠন। দুর্নীতিমুক্তকরণ ফোরামের মহাসচিব মকসুদ আহমদ বলেন, অস্বাভাবিক করের দায় নগর ভবনকে নিতে হবে। কারণ তারা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
সিসিক সূত্র মতে, ওয়ান-ইলেভেনের সময় হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করার পর সে অনুপাতেই প্রদান করছেন মালিকরা। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাঁর ৫০ হাজার টাকা কর দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, তিনি দিচ্ছেন ৫ হাজার টাকা। নতুন ও পুরোনোসহ অনেক ভবন মালিক আবার থেকে গেছেন করের বাইরে। অতীতে মেয়রদের কাছ থেকে কেউ কর মওকুফ, কেউ আবার কমিয়ে নিয়েছেন। তাদের তালিকায় বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিও রয়েছেন। বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে মেয়র আরিফুল হক তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৯-২০২০ সালে ফিল্ড সার্ভে করেন। নতুন কর নির্ধারণ করে পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট পরিষদের বিশেষ সভায় সেটি পাস করেন। তবে তা আদায়ের উদ্যোগ নেননি আরিফ। তিনি এ বিষয়ে সমকালকে জানিয়েছেন, করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কর আদায় শুরু করা হয়নি। তিনি অস্বাভাবিক করের বিষয়টি আবার বিবেচনা করতে নতুন মেয়রের প্রতি আহ্বান জানান।
সিসিক ভবনের সামনে কর আদায় ও আপত্তি থাকলে তা মূল্যায়ন করার জন্য কার্যক্রম চলবে ২৮ মে পর্যন্ত। এসব বুথ থেকে গতকাল পর্যন্ত তথ্য নিয়েছেন ২৪ হাজার ৪৬৭ জন। আপত্তি ফরম নিয়েছেন ২২ হাজার ৪৪০ জন। বকেয়া কর আদায় হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান জানিয়েছেন, অনেক ভবন রয়েছে, যার সঠিক অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। আবার অনেক ভবন মালিক রয়েছেন, যারা সঠিক কর দেন না। নতুন করারোপের আগে রি-অ্যাসেসমেন্ট করেই করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে অনেকের করের ব্যবধান বেশি হয়। তবে নতুন পরিষদ কমানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
সমকাল