খালি ফানি আর ফানি : বাড়ি-ঘর বাঁচামু না নিজে বাঁচমু ?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০১৯, ১:০৮ পূর্বাহ্ণ
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, হাওরাঞ্চল ঘুরে:
“ভাই আমরারে দেখতে আইছেন, দেহেন বন্যার পানির সাথে যুদ্ধ করইরা কীভাবে বাঁইচা আছি। দেখেননা যে দিকে চাইবেন খালি ফানি আর ফানি। কোনো গাঁও গেরাম দেহা যায়না, হাওরের কুল-কিনার নাই। যেভাবে ঢেউ আয় ঘরবাড়িতে থাকাই দায়। বাড়ি-ঘর বাঁচামু না নিজে বাঁচমু এই চিন্তায় শেষ। গেরাম ডুইবা গেলে বউ-বাচ্চা লইয়া মরণ ছাড়া গতি নাই। শহরের মানুষেরতো চিন্তা নাই, ফানি বেশী অইলেই কি-না হইলেই কী। তারার তো আর ঢেউয়ের ভয় নাই, ঘরবাড়িও ভাঙ্গেনা। হাওরে আমরা কীভাবে থাকি দেইখ্যা যান। মাঝে-মাঝে মনে অয় এলাকা ছাইড়া চইলা যাই। আবার ভাবি বাপ-দাদার ভিটা মাটি, জমি জিরাত আত্মীয় স্বজ্জন ছাইড়া কই যামু ,কি করমু হের লাইগাই যাইনা।” এমন আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনা হাওরের বাসিন্দা জয়নাল মিয়া।
ট্রলার দেখে এগিয়ে এসে এক মহিলা জানতে চায় “কিছু দিবায়নি, চাউল দিবায় না টেহা (টাকা) দিবায়। আমরাতো বস্তা নিয়া বহু সময় খাড়া হইয়া তোমরার ট্রলার দেখতাছি। ভাবতাছি তোমরা মনে হয় আমরার লাগি কিছু খাওন লইয়া আইতাছো। আইজ সারা দিনে কোন রকম এক বেলা আধা পেট খাইছি। বাচ্ছারার কান্দন সইতা ফারিনা, বুকের দুধ দিয়া চুপ করাইতে হয়। চুলাত ফানি হের লাইগা ভাতরান্দা বন্ধ।” এভাবেই জীর্ণশীর্ণ হয়ে কিছু খাবার আকুতি জানিয়েছিলেন পাকনা হাওরের নিভৃত পল্লী হঠামারা গ্রামের বিলপাড় হাটির ৩৫ উর্ধ্ব এক নারী। তার মতো বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে যেয়ে জুরমত বিবি, মাফিয়া বেগম, সুলতানা বেগম, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল হকসহ অর্ধশতাধিক মানুষ ট্রলার নৌকার শব্দ শুনে ত্রাণের আশায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন নিজ নিজ বাড়ির ঘাটে। তারা জানান, ট্রলার নৌকার শব্দ শুনলেই তারা মনে করেন ত্রাণ নিয়ে আসছেন কেউ। এ কারণেই পানিবন্দি ঘর থেকে বাহিরে এসে দাঁড়ান ত্রাণ পেতে। এদিকে জামালগঞ্জ সদরের মাছবাজার সংলগ্ন সুরমা নদীর তীরে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত সিকান্দর আলীর ঘরে হাঁটু পানি থাকায় ওই পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঘরে প্রবেশ করে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান জামালগঞ্জ সরকারী মডেল উচ্চ বিদ্যারয়ের শিক্ষার্থী রেজাউল তার মা ও ছোট বোনকে নিয়ে চৌকিতে বসে আছেন। মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বলেন, ৬ দিন যাবত তারা পানিবন্দি আছেন। চুলা ডুবে গেছে, তাই রান্নাও করতে পারেননা। গতকাল চৌকিতে একটি টিনের বিকল্প চুলা দিয়ে খিচুরি রান্না করে কোন রকম খেয়েছেন। তারা জানান, সরকারী এক প্যাকেট ত্রাণ পেয়েছেন এগুলোই খেয়ে কোন রকম সময় পার করছেন। সুনামগঞ্জের বন্যার্তরা ৫ দিন পর বাড়ি ছাড়লেও বেশীর ভাগ বন্যার্থরা আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে আত্মীয়-সজ্জনদের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। জেলার সব ক’টি উপজেলায় এমন খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে হাওরবাসিন্দরা আতংকে মানুষ বাড়ি ছেড়ে, আশ্রয় নিচ্ছেন আত্মীদের বাড়িতে।
জেলার জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, দিরাই, শাল্লা উপজেলার দ্বীপসদৃশ গ্রামগুলোর বন্যার্তরা নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বন্যায় প্রবল ঢেউয়ের সাথে বাড়ছে হাওরবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনেক পরিবার এখন খাওয়ার তাগিদে যে কারো কাছে হাত পাততে দ্বিধাবোধ করেন না তারা। এভাবেই চলছে বন্যার্ত হাওরবাসীর দিনকাল। সরেজমিন হাওরের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে হঠামারা, উদয়পুর, নাজিম নগর, শ্রীমন্তপুর, জসমন্তপুর, মিলনপুর সহ বহু গ্রামের বন্যার্তদের চরম বিপর্যয়। কোন কোন জায়গায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয়, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ নানাবিদ সংকট বিরাজ করছে। এই বিপর্যয়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে বন্যার্ত পরিবারের আর্তনাদ থামছে না। বন্যা বিপর্যয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বৈশাখে বোরো ফসল গোলায় ওঠার সময় যে কৃষকরা অকাতরে লোকজনের মধ্যে ধান বিলি করতেন, তাদের অনেকের ঘরে পানি উঠার কারণে ত্রাণের আশায় প্রহর গুণছেন। পানিবন্দী বহু গ্রামের লোকজন এখন একবেলা, আধাবেলা ও অনেক পরিবারের সদস্যদের শুকনো খাবার খেয়ে কোন রকম দিন কাটাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের চেয়ে একবোরেই কম। যৎ সামান্য ত্রাণ তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এমন পরিবারও রয়েছে এখনো কোনো ত্রাণ পায়নি। অনেকেই তাদের গরু আর গো খাদ্য নিয়ে পড়েছেন মহা বিপাকে। বন্যার্থ হাওরবাসী ঢেউ থেকে ঘরবাড়ি বাঁচাতে ও নিজেদের বাঁচার দুশ্চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন।
জেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯ টি উপজেলার প্রায় ১৩ হাজার ঘর-বাড়িতে সম্পূর্ণ ও আংশিক বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তবে বে-সরকারী হিসেবে প্রায় ২ লাখ পরিবারের বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করেছে বলে জানান বানবাসী মানুষ। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণের প্যাকেটসহ চাল, শুকনো খাবার প্রদান অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ভাবে ১০টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ সকল স্কুল গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সূত্র- দৈনিক জালালাবাদ