সিলেটে ঈদের পর পরই ৫ জন খুন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০১৯, ৬:৫১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
ঈদের ছুটিতে সিলেটের সদর উপজেলা ও বিশ্বনাথ এবং সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, তাহিরপুর এবং হবিগঞ্জের লাখাইয়ে পৃথক ৫টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বিশ্বনাথে আওয়ামী লীগ নেতা, সিলেট সদরে চাচার হাতে ভাতিজা ও তাহিরপুরে সুদের টাকা নিয়ে মারামারিতে যুবক, জগন্নাথপুরে বাড়ির পানি নিষ্কাশন নিয়ে এক ব্যক্তি এবং হবিগঞ্জের লাখাইয়ে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আরো একজন খুন হয়েছে। সবমিলিয়ে খুন হয়েছেন ৫ জন। বৃহস্পতিবার ও মঙ্গলবারে এসব ঘটনা ঘটে।
ঈদের পরদিন সিলেট সদর উপজেলার শিবের বাজার রায়েরগাঁও গ্রামে চাচার হাতে ভাতিজা খুন হন। নিহতের নাম দুলাল আহমদ (২০)। তিনি ওই গ্রামের মৃত আবুল বশরের ছেলে। তবে হত্যাকান্ডের ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
পরিবারের দাবি বৃহস্পতিবার সকালে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে চাচা সিরাজুল ইসলামের হামলায় গুরুতর আহত হন দুলাল আহমদ (২০)। পরে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অকিল উদ্দিন আহমদ জানান, শিবের বাজার রায়েরগাঁও গ্রামে চাচার হাতে ভাতিজা খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় নিহত দুলাল মিয়ার ভাই হেলাল আহমদ বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
বিশ্বনাথ থেকে আক্তার আহমদ শাহেদ জানান, বিশ্বনাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও এলাকার সালিশ ব্যক্তিত্ব আহমদ আলীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের পুরান সৎপুর গ্রামস্থ নিজের মৎস্য খামার থেকে আহমদ আলীর লাশ উদ্ধার করেছে থানা পুলিশ। তিনি দক্ষিণ সৎপুর গ্রামের মৃত ওহাব উল্লাহর ছেলে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্থানীয় টিকির বাজারে যান আহমদ আলী। এদিকে রাত ৮টার পর্যন্ত আহমদ আলী ছেলের খুঁজে বের হয়েছিলেন। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পান পরিবারের লোকজন। আহমদ আলীর মোবাইল বন্ধ পেয়ে পরিবারের লোকজন ও এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে আহমদ আলীকে খুঁজতে বের হন।
খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে পুকুরের পশ্চিম-দক্ষিণ কোনার দিকে তার লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে সুরতহাল শেষ করে ময়না তদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে। ঘটনার পর থেকে মৎস্য খামারের প্রহরী সৎপুর খাসজান গ্রামের মৃত ময়না মিয়ার পুত্র জমির হোসেন (৩০) পলাতক রয়েছে। আহমদ আলী খুন হওয়ার ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
নিহত আহমদ আলীর পরিবারের দাবি, এলাকার একটি সালিশ বৈঠক ও মৎস্য আড়ৎ কমিটি গঠনের জের ধরেই পূর্ব পরিকল্
পনা অনুযায়ী আহমদ আলীকে দেওকলস ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাছুম আহমদ মারুফ ও তার সহযোগীরা মৎস্য খামারের প্রহরী জমির হোসেনের সাথে আঁতাত করে হত্যা করেছেন। পুকুর থেকে লাশ উদ্ধারের পর আহমদ আলীর সাথে থাকা মোবাইল ফোন, পায়ের জুতা, টর্চ লাইট ও পকেটে কোনো টাকা পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন পরিবার ও এলাকাবাসী।
সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতকারী বিশ্বনাথ থানার এসআই দিদারুল আলম জানান, লাশের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ও শরীরের একাধিক স্থানে জখম রয়েছে। তবে বিশ্বনাথ থানার পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ দুলাল আকন্দ বলেন, প্রাথমিক ধারণায় মনে হচ্ছে আহমদ আলীকে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় উপজেলার সৎপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মরহুমের লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাজার নামাজে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী, বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য এস এম নুনু মিয়া, বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা পিপিএম, পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ দুলাল আকন্দ, বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব পংকি খান, ওসমানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদাল মিয়া, জেলা পরিষদের সদস্য সহল-আল রাজী, বিশ্বনাথ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছয়ফুল হক, দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির আলী, দেওকলস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাহিদ মিয়া প্রমুখসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এসময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করে জেলা ও উপজেলাসহ সর্বস্তরের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
তাহিরপুর থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানান, সুদের টাকার জের ধরে তাহিরপুরে তাদির মিয়া(২৬) নামে এক যুবক খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।খুন হওয়া যুবক উপজেলার বড়দল দক্ষিণ ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের সাজিদ মিয়ার ছেলে।
এলাকাবাসী জানান, উপজেলার রসুলপুর গ্রামের সাজিদ মিয়ার কাছে প্রতিবেশী হাদিছ মিয়ার সুদের ২০ হাজার টাকা পাওনা ছিল। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে পাওনা টাকা পরিশোধ করার জন্য হাদিছ মিয়া প্রতিবেশী সাজিদ মিয়াকে চাপ দেয়। এ সময় সাজিদ মিয়ার পুত্র তাদির মিয়া (২৬) সুদের টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে শুধু মূলধন পরিশোধ করবে বলে জানায়। হাদিছ মিয়া সুদসহ সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করার জন্য বললে উভয়েই কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে হাদিছ মিয়া উত্তেজিত হয়ে তাদির মিয়া (২৬) এর মাথায় কাঠের লাঠি দিয়ে আঘাত করে।
মাথার আঘাতে অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাদির মিয়াকে রাতেই সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। গত বুধবার সকালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে পুলিশ এখন পর্যন্ত আটক করতে পারেনি।
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান জানান, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
আমাদের জগন্নাথপুর প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় হায়দর আমিন (৪৬) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ৩ সহোদর। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে উপজেলার আশারকান্দি ইউপির নয়া দাওরাই গ্রামে ঘটনাটি ঘটে। নিহত হায়দর আমিন দাওরাই পশ্চিমপাড়া গ্রামের আখলুছ মিয়ার ছেলে।
আহতরা হলেন, আখলুছ মিয়ার আরো তিন ছেলে নুরুল আমিন টুনু (৪৮), বদরুল আমিন (৩৫) ও ফয়ছল আমিন (২৫)।এদিকে, হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে নয়া দাওরাই গ্রামের ওয়ারিশ মিয়ার স্ত্রী সিতারা বেগম (৪৮) নামের এক নারীকে পুলিশ আটক করেছে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সিতারা বেগমসহ তার স্বামী ওয়ারিশ মিয়া ও সহযোগীরা হত্যাকা-ের সাথে জড়িত ছিল এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জগন্নাথপুর থানার ওসি ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী।
নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিহত হায়দর আমিনাদের বাড়ির পানি নিষ্কাশনকে কেন্দ্র করে গত ২ দিন পূর্বে একই গ্রামের পাশের বাড়ির গফুর, ফখরুল ইসলাম, ওয়ারিশদের সাথে হায়দরের পরিবারের সদস্যদে কথাকাটাকাটি হয় এবং এক পর্যায়ে ঝগড়া বাঁধে। পরে বিষয়টি স্থানীয় সালিশ ব্যক্তিরা সালিশের মাধ্যমে সমাধান করার প্রক্রিয়া নেন। এরই মধ্যে প্রতিপক্ষ গফুর, ফখরুল ইসলাম ও ওয়ারিশরা তাদের আত্মীয় স্বজনসহ অন্য সহযোগীদের নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে হায়দরদের বাড়িতে গিয়ে তাদের চার ভাইয়ের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় হায়দরসহ তারা চার সহোদর আহত হন। মুমূর্ষু অবস্থায় হায়দরকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হায়দর আমিন মারা যান। হায়দার আমিনের মৃত্যুর পর পর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে জগন্নাথপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল নয়া দাওরাই গ্রামে অভিযান চালিয়ে হত্যার সাথে জড়িত ওয়ারিশ মিয়ার স্ত্রী সিতারা বেগমকে (৪৮) আটক করে। এ সময় ওয়ারিশ মিয়ার বসতঘর থেকে হত্যাকা-ে ব্যবহƒত বেশ কিছু দেশীও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর থেকে হত্যাকারীরা পলাতক রয়েছে।
জগন্নাথপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে দুই গ্রামবাসীর মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে একজন নিহত ও অন্তত অর্ধশত লোক আহত হয়েছেন। দুই পক্ষের লোকজনের কথাকাটাকাটির জের ধরে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্তত ২৫ রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে।
পুলিশসহ স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলার আমান উল্লাহপুরের বাসিন্দা লাখাই ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাবলু এবং রুহিতনশী গ্রামের বাসিন্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শরীফ উদ্দিন উভয়েই ঢাকায় থাকেন। সেখানে তাদের লোকজনের মাঝে দেনা পাওনা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তারা ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে আসেন।
শুক্রবার বিকেলে লাখাই গ্রামের বটতলা বাজারে উভয়পক্ষের লোকজন ফের কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়। এ নিয়ে বাবলুর পক্ষে আমান উল্লাহপুর এবং শরীফ উদ্দিনের পক্ষে রুহিতনশী গ্রামের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শরীফ উদ্দিনের পক্ষের সামাদ মিয়ার পুত্র জামিরুল ইসলাম (৩৫) ঘটনাস্থলেই মারা যান। এতে গুরুতর আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
লাখাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. এমরান হোসেন জানান, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে, সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিহত জামিরুলের মরদেহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে।