নতুন প্রজন্মের দেশে যেতে অনীহা, সিলেটে নেই লন্ডনী বিয়ের ধুম
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মে ২০১৯, ১২:২২ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
‘লন্ডনী বিয়ে’ লন্ডন-সিলেটে সম্পর্ককে বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। ‘লন্ডনী বিয়ে’র ধুম নেই সিলেটে। প্রবাসী অধ্যুষিত বৃহত্তর সিলেটে এ চিত্র এখন বাস্তবতা। অথচ স্থানীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ ব্রিটেন স্পাউস ভিসা শর্ত কঠোর করায় কমে গেছে বিয়ের এ আয়োজন। এর মধ্যে দিয়ে লন্ডন-সিলেটে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কের গভীর বিস্তৃতি কার্যত থমকে গেছে। সেই সাথে কমে গেছে দেশে প্রবাসীদের আসা-যাওয়া। যারা আসছেন তারা একান্ত প্রয়োজনে। সেই প্রয়োজনের বড় অংশ নিজ নিজ সহায় সম্পত্তির খোঁজে। এর মধ্যে বিক্রির বিষয়টিও ইদানিং নতুন মাত্রা পেয়েছে। নিরাপত্তাসহ রক্ষণাবেক্ষণ ঝুঁকিতে পড়ে প্রবাসীরা নীরবে যে যার মতো করেই বিক্রি করে ফিরে যাচ্ছেন প্রবাসে। বাপ-দাদার ভিটে মাটির চিহ্ন অবশিষ্ট রেখে বাকি যা সম্ভব সবই বিক্রিতে তুলে দিচ্ছেন তারা। অনেক প্রবাসী দেশে বিনিয়োগ করলেও সেই বিনিয়োগও তারা ধরে রাখতে চাইছে না নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়ে। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে নির্ভরতা সংকট। তাই ভবিষ্যত নিয়ে চরম শঙ্কিত প্রবাসীরা।
তাদের সেই সংকটে যোগ হয়েছে প্রবাসী নতুন প্রজন্মও। তারাও অভিভাবকদের ঝামেলা মুক্ত রাখার পক্ষে। দেশের কোন সমস্যায় তারা যেমন জড়াতে রাজি নয়, তেমন চায় না পিতা মাতাদেরও। তাই সবকিছু গুটিয়ে প্রবাসে একমুখী হওয়ার মানসিকতা তাদের। অনেকের ধারণা, দেশ তথা সিলেটে কেবল বেড়াতে যাওয়া যেতে পারে অন্য কিছু বাদে। এদের মধ্যে যারা দেশে আসছে তারা পুনরায় যে আসবে এমন সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রবাসীদের পাশাপাশি তাদের নতুন প্রজন্ম দেশে আসার পর স্বাগতমের বিপরীতে পদে পদে জুটছে হয়রানিসহ অপ্রত্যাশিত নানা অঘটন। বেড়ানোর আনন্দের চেয়ে তিক্ত নানা অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে ফিরে যাচ্ছে তারা। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার সূচনা হয় দেশে অবতরণের পরই। বিশেষ করে এয়ারপোর্ট কেন্দ্রীক হয়রানি প্রবাসীদের চরমভাবে হতাশ করে। এহেন পরিস্থিতি অর্থনৈতিক মানদণ্ডে শুধু নয়, সার্বিক বিচারে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমনটি আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২০ লক্ষাধিক সিলেটীদের বসবাস। বিশেষ করে ইউরোপের ব্রিটেনে সিলেটীদের সিংহভাগ পরিবার পরিজন। এদের অনেক বংশানুক্রমে এখন ব্রিটেনের বাসিন্দা। এছাড়া বৈবাহিক সূত্রে দীর্ঘতর হয়েছে ব্রিটেনে সিলেটীদের যাতায়াত। মেধাবী ও সুন্দর ছেলে মেয়েদের লন্ডনী আত্মীয় স্বজনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে পাড়ি দিয়েছে সুদুর ব্রিটেনে। এতে করে সিলেটে পরিচিতি লাভ করে লন্ডনী বিয়ে। সেই লন্ডনী বিয়ের সুবাদে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিরাট অগ্রগতি এসেছে সিলেটে। আর্থসামজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুধু নয়, চিন্তা চেতনায়ও দুরদর্শিতা লক্ষণীয়। দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তনে উন্নত মানসিকতাসহ রুচিশীলতা অলংকার হয়ে দাঁড়িয়েছে সিলেটীদের যাপিত জীবনে। কিন্তু সেই অবস্থার পথে এখন বাধা প্রবাসীদের সামনে চলমান প্রতিকূল পরিবেশ। তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্থানীয়দের ব্যর্থতার পাশাপাশি ব্রিটেন সরকারের স্পাউস ভিসা শর্ত কঠোর করার সিদ্ধান্ত। এই অবস্থায় বাংলাদেশী তথা সিলেটের যারা ব্রিটেনে বাস করেন, তারা এই কঠোর শর্তারোপের কারণে ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে দেশে এসে বিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছেন না। মূলত ব্রিটেন সরকার স্পাউস ভিসায় স্বামী বা স্ত্রীকে ব্রিটেনে নিয়ে যেতে বছরে বিরাট অংকের আয় সীমা বেঁধে দেয়ার কারণে প্রতিবছর অসংখ্য স্পাউস ভিসা প্রার্থী বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন।
ব্রিটেনে বসবাসকারী প্রবাসী সিলেটীদের একটি বড় অংশই দেশে (বাংলাদেশে) এনে সন্তানদের বিয়ের আয়োজন করে থাকেন। এ ধারাবাহিকতা চলে আসছে কয়েক যুগ ধরেই। বিলেত প্রবাসী বর কনেদের দেশে এসে বিয়ে করার এই লন্ডনী বিয়ের হারও স্পাউস ভিসায় শর্তারোপের কারণে অনেকটা কমে গেছে। ব্রিটেনের আইনে ইউরোপের বাইরে থেকে স্পাউস আনতে স্পন্সরের বছরে কমপক্ষে ১৮ হাজার ৬শ’ পাউন্ড আয় থাকতে হবে। মাইগ্র্যান্ট রাইটস নেটওর্য়াকের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এ নতুন আইনের কারণে ৪৭ শতাংশ কর্মরত ব্রিটেনের নাগরিকের পক্ষে ইউরোপের বাইরের দেশ থেকে স্পা আনা সম্ভব হচ্ছে না। স্পাউস ভিসা পাবার ক্ষেত্রে এ বিড়ম্বনার কারণে ব্রিটেনে এখন অনেক পরিবারে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ দূরত্বের। স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানদের মধ্যে বিরাজ করছে বিচ্ছেদের বেদনা। মাইগ্র্যান্ট রাইটস নেটওয়ার্কের পলিসি ডাইরেক্টর রুথ গ্রুভ বলেছেন, আয়সীমার এ বিশাল দেয়াল মানুষের সম্পর্ক প্রভাব ফেলছে। যে ব্যক্তি নির্ধারিত সীমায় আয় করতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি তার পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
এদিকে হোম অফিসের ইমপেক্ট এসেসমেন্টে দেখা যাচ্ছে,স্পাউস ভিসার নতুন নিয়মে প্রতি বছর প্রায় ১৭ হাজার ৮শ ভিসা প্রাপ্তি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। গত জুলাইয়ে হাইকোর্ট ১৮ হাজার ৬’শ আয়ের নিয়মাবলিকে অবৈধ ঘোষণা করে সরকারকে এই আয়ের সীমা ১৩ হাজার ৫’শ পাউন্ড করার নির্দেশ দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলেও রায় প্রকাশ করা হয়নি এখনও। অপরদিকে, স্থানীয় পরিবেশ প্রতিবেশ অনুকূলে নয় প্রবাসীদের জন্য। ভুক্তভোগীদের মতে, নাড়ির টানে দেশে আসি। সঙ্গে নিয়ে আসি আমাদের সন্তানদের। কিন্তু দেশে এসে এমন কোন পরিবেশ দেখাতে পারি না, যা দেখে তারা কৌতুহলী হবে, কিংবা মনে রাখবে তাদের পিতা-মাতার দেশকে। গরীব হলেও ঐশ্বর্য রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে দেশের মাটি স্পর্শের পর সার্বক্ষণিকভাবে প্রবলেম’র মধ্যে থাকতে হয় আমাদের। কোথাও কোন প্রতিকার নেই। নির্ভরতাহীন একটি পরিবেশে সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে যাই। এরপর অতি প্রয়োজনে আমরা আসলেও সন্তানদের নিয়ে আসা আর সম্ভব হয় না। অথচ তারা ঘুরতে যায় বিশ্বের অচেনা অজানা কোন দেশে। তাদের কাছে সেই দেশ নিরাপদ।