নিঃস্বার্থ শ্রম পরিবারের অভিভাবক পাশাপাশি শিক্ষাবান্ধব ইসমাইল মাহমুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জুলাই ২০১৭, ৪:২১ অপরাহ্ণ
তোফায়েল আহমেদ পাপ্পু, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার থেকেঃ বছর দুয়েক আগের কথা। শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের উত্তর কালাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী দুই পক্ষের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়ভাবে অনেক চেষ্টা করেও বিরোধ মীমাংশা করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা শিক্ষা অফিসের অনুরোধে স্থানীয়ভাবে বিরোধ মীমাংশা করতে সেখানে যান শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বর্ডার গার্ড পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় (বিজিবি স্কুল) ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সাংবাদিক-শিক্ষানুরাগী ইসমাইল মাহমুদ। প্রচন্ড গরমে বসে প্রায় তিন ঘন্টা চেষ্টার পর উভয়পক্ষের সম্মতি নিয়ে কমিটি গঠন করতে সক্ষম হন ইসমাইল মাহমুদ। সভায় বসেই তিনি ঘোষণা দেন বিদ্যালয়ে একটি বৈদ্যুতিক পাখা প্রদান করবেন। বাকি কক্ষগুলোর পাখা নব-গঠিত কমিটির সদস্যরা নিজেদের অর্থায়নে ক্রয় করবেন এ দাবী করেন ইসমাইল। সকলেই সম্মত হন। এ সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতিটি কক্ষে পাখা লাগানো হয়।
গত জানুয়ারি মাসে সাংবাদিক-শিক্ষানুরাগী ইসমাইল মাহমুদ মির্জাপুর ইউনিয়নের ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গমন করেন। বিদ্যালয়গুলোতে প্রবেশ করতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়ে প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েরই জাতীয় পতাকার রঙ ফ্যাকাশে। একটি বিদ্যালয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ছোট সাইজের জাতীয় পতাকা। এ ঘটনা তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সঠিক রঙ ও মাপের জাতীয় পতাকা বিতরণের উদ্যোগ নেন তিনি। ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু করে এ কাজ। এ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, কিন্ডার গার্টেন, মাদ্রাসায় সঠিক রঙ ও মাপের শতাধিক জাতীয় পতাকা বিতরণ করেছেন। এখনো জাতীয় পতাকা বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। সাথে দিচ্ছেন জাতীয় পতাকার মাপ ও উত্তোলনের নিয়ম সম্বলিত একটি করে লিফলেট। তাঁর এ মহতি উদ্যোগ সর্বমহলে ব্যাপক প্রসংশিত হয়। ইতোমধ্যে তাঁকে এ মহতি উদ্যোগের জন্য সম্মননা প্রদান করেছে শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেধাবী দুই ছাত্রী আপন দুই বোন জেলি ও শেলি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। খবরটি শুনার সাথে সাথে ইসমাইল মাহমুদ ছুটে যায় দরিদ্র পরিবারের এই দুই বোনের বাড়িতে। বাড়িয়ে দেন সহায়তার হাত। প্রতিশ্রুতি দেন এই দুই বোনকে আজীবন শিক্ষা সামগ্রী দিয়ে লেখাপড়া অব্যাহত রাখার জন্য সহায়তা করবেন। ইতোমধ্যে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন শিক্ষা উপকরণ।
চলতি বছরে বাবুর্চি শফিকের ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী ইসমাইল-এর লেখাপড়া বন্ধ হবার উপক্রম হয়। বাবা অসুস্থ্য থাকায় তার পরিবারে কয়েকদিন চুলোও জ্বলেনি। এ অবস্থায় ইসমাইলের বিদ্যালয়ে ভর্তি ফি’সহ আনুষাঙ্গিক খরচ জোগানো পরিবারের জন্য অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। খবরটি শুনার সাথে সাথে ইসমাইল মাহমুদ তার বাসায় গিয়ে তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা, স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহায়তা করেন। মেধাবী শিক্ষার্থী ইসমাইল এখন নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে শিক্ষানুরাগী ইসমাইল মাহমুদ শিশুশ্রম বন্ধে একটি ওরিন্টেশন কোর্সে অংশ নিতে উপজেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যান। সেখানে শিক্ষার্থীরা দৈনিক সমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত ভুলভাবে গাইছিল। এ সময় বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলীও ছিলেন। পরদিনই ইসমাইল মাহমুদ ‘গাওয়ার জন্য জাতীয় সঙ্গীত’ ছাপিয়ে বিদ্যালয়গুলোতে বিতরণ শুরু করেন। উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়েই তাঁর এ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। প্রতি শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘গাওয়ার জন্য জাতীয় সঙ্গীত’ বিতরণ করায় এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দৈনিক সমাবেশে সঠিকভাবে শুদ্ধ উচ্চারণে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছে।
ইসমাইল মাহমুদ শ্রীমঙ্গল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক শ্রীমঙ্গলেরচিঠি’র সম্পাদক। তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল ছাড়াও পত্রিকার বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বাবদ মোট আয় থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে এবং ১০ শতাংশ পথশিশুদের কল্যাণে ব্যায় করছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যায় প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে এবং পথশিশুদের কল্যাণের টাকা ব্যায় করছেন দুই ঈদ ও দুর্গাপূজোয়।
স্টুডেন্টস হেলপিং ফাউন্ডেশন ও উসর্গ নামের দুটি আর্ত-সামাজিক সংগঠনের উপদেষ্টা ইসমাইল মাহমুদ। ২০০৫ সাল থেকে স্টুডেন্টস হেলপিং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এলাকার অসহায়, দরিদ্র, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, স্কুল ড্রেস, ভর্তি ফি দিয়ে সহায়তা করে আসছেন। আর ২০১৪ সাল থেকে উৎসর্গের মাধ্যমে প্রতি ঈদে পথশিশুদের মাঝে ঈদের পোশাক বিতরণ ও শীতে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ করে আসছেন।
শ্রীমঙ্গলের মেধাবীদের মেধাব উকর্ষ মূল্যায়নে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন শিক্ষানুরাগী মিলে গড়ে তুলেন ‘বাতায়ন’ নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষানুরাগী ইসমাইল মাহমুদ। ইতোমধ্যে সংগঠনটি শ্রীমঙ্গল তথা মৌলভীবাজার জেলায় কর্মযজ্ঞের কারনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এসব কর্ম ছাড়াও ইসমাইল শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়াল ঘড়ি প্রদান, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে কম্বল বিতরণ, খাতা-কলমসহ শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে চলেছেন।
নিজের স্কুল শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেচম্যান্ট এলাকার শিক্ষার্থীরা শতকরা ৮৫ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা দি বাডস রেসিডেন্টসিয়্যাল স্কুল এন্ড কলেজ অথবা বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ বর্ডার গার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে। নিজ বিদ্যালয়ে যেসব দরিদ্র শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করছে তাদের পুরো বছরের খাতা নিজ অর্থায়নে বিনামূল্যে প্রদান করছেন ইসমাইল মাহমুদ।
ইসমাইল মাহমুদের ফুফা মহফিল হোসেনসহ তাঁর পরিবারের বেশ কয়েকজন মহান মুক্তিযোদ্ধে শহীদ হন। ইসমাইলও মনে-প্রাণে দেশত্ববোধ ও মহান মুক্তিযোদ্ধের চেতণা ধারণ করেন। শ্রীমঙ্গল শহরের বিজিবি সেক্টরের পাশে অবস্থিত ‘বধ্যভূমি-৭১’সহ মহান মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিকে সংরক্ষণে তিনি কাজ করে চলেছেন। বধ্যভূমি-৭১ এর উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ বধ্যভূমি-৭১ এ স্থাপিত ১৩ জন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকায় তাঁর নামও স্থান পেয়েছে।
সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন দেশের নির্বাচিত উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে ‘সততা স্টোর’ নামের দোকান খোলার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বিক্রেতাবিহীন এসব দোকানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে শিশুকাল থেকেই সততা জাগ্রত করা এবং পুথিগত শিক্ষাদানের সাথে সাথে শিশু বয়স থেকেই সততার অভ্যাস করানোর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও ‘সততা স্টোর’ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ‘সততা স্টোর’ এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যা সম্ভব হয়েছে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি শিক্ষানুরাগী ইসমাইল মাহমুদের উদ্যোগ ও সহযোগিতায়।
শিক্ষানুরাগী-সমাজকর্মী-সাংবাদিক ইসমাইল মাহমুদের এসব কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি শ্রীমঙ্গল উপজেলা শাখার সভাপতি জহর তরফদার বলেন, ‘ইসমাইল মাহমুদ এবং তার বাবা মরহুম মো. কালা মিয়া এ দু’জনই শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। ইসমাইল মাহমুদ শ্রীমঙ্গলের প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে জাতীয় পতাকা বিতরণ করেন। এটা আমাদের জন্য এক অনন্য গৌরব। তিনি বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ মাদ্রাসায়ও গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে যাচ্ছেন এবং অন্যদেরকেও শিক্ষা উপকরণ বিতরণে প্রতিনিয়তই উৎসাহ দেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিন সংগঠনের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। এছাড়া সুবিধা বঞ্চিত যারা লেখা-পড়ার খরচ চালাতে পারে না তাদেরকেও বিভিন্নভাবে নিজে সহযোগিতা করেন এবং অন্যান্য বৃত্তশালীদের মাধ্যমেও সহযোগিতা করে থাকেন। ইসমাইল মাহমুদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ইসমাইল মাহমুদ একজন দক্ষ এবং সামাজিক লোক। সমাজ বিনির্মাণে তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষিত, মার্জিত, নিপাট ভদ্র মানুষ। তিনি শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সহযোগিতা এবং দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। বিদ্যালয় পরিবেশ উন্নয়নের জন্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ইসমাইল মাহমুদ সবসময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। ইসমাইল মাহমুদের মত শিক্ষিত-মার্জিত-শিক্ষানুরাগী লোক আমাদের সমাজে প্রয়োজন আছে। তাদের মত লোক থাকলে সমাজ আরো দ্রুত উন্নতির চুড়ায় এগিয়ে যাবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধন সম্ভব হবে।’