সিলেটে জামালের প্রতারণার ফাঁদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুন ২০১৭, ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সিলেটের জামালউদ্দিন। গাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার রহস্যময় ‘তরিকা’ তুলে ধরেন তিনি। আর তার এই তরিকার ফাঁদে পড়ে এখন নিঃস্ব অনেকেই। ফ্ল্যাট, গাড়ি তো দূরের কথা এখন বিনিয়োগের টাকাই পাচ্ছেন না। অন্যদিকে মামলার বোঝা কাঁদে নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন জামালউদ্দিন। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন বেকায়দায়ও। জামালউদ্দিনের বয়স বেশি নয়। ৩৫ কিংবা ৩৬ হবে। বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার দুবাইবাজারের হিলালপুর গ্রামে। সিলেটে চারাদিঘীরপাড়ের আল-আমীন আবাসিক এলাকায় ভাইয়ের বাসায় ওঠেন। প্রায় ১০ বছর আগের গল্প এটি। কিন্তু এ সময়ে জামালউদ্দিন সিলেটে হয়ে উঠেছেন আলোচিত ব্যক্তি। ইতিমধ্যে পরিচিতজনসহ নানাজনের কাছ থেকে লুটে নিয়েছেন প্রায় দেড় কোটি টাকা। চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘বিলিভ অ্যান্ড ট্রাস্ট বিজনেস লি.’। এই কোম্পানির সবার বাড়ি চট্টগ্রামে। কেবল চট্টগ্রামের বাইরে কোম্পানির পরিচালক হন সিলেটের জামালউদ্দিন। আর এ কোম্পানির পরিচালক হওয়ার পর থেকে তার ভাগ্য খুলে যায়। সিলেটে স্থানীয়ভাবে এ কোম্পানির পরিচালক খুঁজতে থাকেন জামালউদ্দিন। পাশাপাশি তিনি ‘সিলেট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন। নাইওরপুলের ‘গনি চৌধুরী টাওয়ার’ হচ্ছে ওই প্রকল্পের স্থান। ১০ তলা টাওয়ার হবে। প্রকল্প গ্রহণের পরপরই জামাল তার ‘বিলিভ অ্যান্ড ট্রাস্ট বিজনেস লি.’ সিলেটের পার্টনার হিসেবে লোক খুঁজতে থাকেন। পেয়েও যান দুজনকে। এরমধ্যে একজন হচ্ছেন আব্দুস সালাম। সালাম সিলেট নগরীর চারাদিঘীরপাড় এলাকার নূরজাহান টাওয়ারের বাসিন্দা। জামালও ওই টাওয়ারে ভাইয়ের বাসায় বসবাস করেন। সালামকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পার্টনার হিসেবে নেন জামাল। কিন্তু আরেক পার্টনার সৈয়দ আকরাম আল সাহানের কাছ থেকে নেন ১৮ লাখ টাকা। ১৫ লাখ টাকায় কোম্পানির পার্টনার করার পর সাহানকে বলা হয়- প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর তাকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। এর বাইরে কোম্পানির লভ্যাংশও তাকে দেয়া হবে। এছাড়া লাইটিং প্রজেক্টের জন্য আরও ৩ লাখ টাকা জামালউদ্দিনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আকরাম আল সাহান। গেল বছর হঠাৎ করেই হাবিব ভবনের অফিস বন্ধ করে দেন জামালউদ্দিন। মোবাইল ফোনও বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে বিনিয়োগকারীরা পড়েন বিপাকে। খোঁজখবর শুরু করেন কোম্পানির সিলেটের অপর দুই পরিচালক সাহান ও সালাম। তারা খবর নিয়ে জানতে পারেন জামালউদ্দিন বিলিভ অ্যান্ড ট্রাস্ট বিজনেস লি. নামে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব নিয়ে কোম্পানির চট্টগ্রাম প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জামালউদ্দিনের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে শোকজ করায় গত বছরের ২৪শে আগস্ট কোম্পানির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এফিডেভিটের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের লিখিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জামালউদ্দিন। ওই স্বীকারোক্তিতে জামালউদ্দিন প্রায় ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায় স্বীকার করেন। লিখিত বক্তব্যে জামালউদ্দিন জানান- ২০১৩ সালে মৌসুমী আহমদ সুমা ও তার বোন সিগমা আহমদ ইভার কাছ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির নামে ৫ লাখ টাকা, জকিগঞ্জের বাবুল আহমদের কাছে থেকে এক লাখ টাকা, বিয়ানীবাজারের আমেরিকা প্রবাসী আব্দুল হকের কাছ থেকে ২০১৪ সালের ২৪শে এপ্রিল থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে ৩২ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা, ২০১৫ সালে হবিগঞ্জের হাফিজুর রহমানের কাছে থেকে ২০ লাখ টাকা ক্যাশ গ্রহণ করেন। এছাড়া হাফেজ মাওলানা কাশেমের কাছ থেকেও ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে কোম্পানির নামে সিলেটে অ্যাকাউন্টও খুলে বসেন জামালউদ্দিন। আত্মসাৎকৃত সব টাকা তিনি প্রথমে কোম্পানির একাউন্টে এবং পরে তিনি নিজ অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেয়। এছাড়া জামাল এহতেনাম খান নামের আরও এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এহতেনাম জানান- তিনি ফ্ল্যাট কেনার অগ্রিম হিসেবে ২ লাখ টাকা ও আরও দুই লাখ টাকার নির্মাণসামগ্রী নেয়া হয়েছে। এদিকে জামালউদ্দিন নিজের লিখিত বক্তব্যে প্রতারণা স্বীকার করার পর কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাডভোকেট কাজী মফিজুর রহমান চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি জামালউদ্দিনের বিরুদ্ধে সিলেটের আদালতে প্রতারণা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলা পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইকে তদন্তে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদী হয়ে চট্টগ্রাম আদালতে একটি চেক ডিজঅনার মামলা করেছেন। এ মামলায়ও পলাতক রয়েছে জামালউদ্দিন। ওদিকে সিলেটের আদালতেও চেক ডিজঅনার মামলা করেছেন কোম্পানির সিলেটের পার্টনার আব্দুল সালাম। মামলায় আব্দুস সালাম জানিয়েছেন- জামালউদ্দিন তার কাছ থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। চেক দিয়েও টাকা দেননি। আর জামালউদ্দিনকে টাকা দেয়ার পর তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না বলেও জানান। কোম্পানির আরেক পার্টনার সৈয়দ আকরাম আল সাহান জানিয়েছেন- তিনি মোট ১৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে তিন লাখ টাকা নিয়ে জামাল লাইটিং ও পাথরের ব্যবসা করে। সাহান জানান, জামালের হাতে তিনি তার সর্বশেষ টাকাটা তুলে দেন। কিন্তু স্ত্রীর অসুস্থতার সময় তিনি চেয়েও টাকা পাননি। ওই সময় জামাল মাত্র এক লাখ টাকা প্রদানে টালবাহানা করে বলে জানান। সাহান জানান, জামালের হাতে প্রতারিত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। এরা এখন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর নিজেকে রক্ষা করতে জামালউদ্দিন এখন বিদেশ পালানোর চেষ্টা করছেন। এ কারণে জামালকে আটক করতে পুলিশকে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।- মানবজমিন।