সিলেট রেজিস্ট্রি অফিসে সিন্ডিকেটের কালো থাবা
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০১৭, ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ: আগুন সবকিছু পুড়িয়ে দেয়, ধ্বংস করে দেয়, বিলীন করে দেয়। সিলেট সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সামনের একটি দোকানে লাগা আগুনেও পুড়ে গেছে অনেক কিছু। তবে সেই আগুনের শিখাতেই স্পষ্ট হয়েছে দুর্নীতি আর অনিয়মের একটি কালো সিন্ডিকেটের ছায়া। যারা পুরো রেজিস্ট্রি অফিসেই ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে। সেই সিন্ডিকেটের সামনে অসহায় রেজিস্ট্রি অফিসের অনেক বড় কর্তাও।
গত ২৫শে এপ্রিল মধ্যরাতে রহস্যজনক এক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পাশে অবস্থিত ‘নাজির স্ট্যাম্প ভেন্ডার’ নামের একটি দোকান। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় আগুন নেভানো হলেও ভেতরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে আকাশমাধ্যমে রাতেই ছড়িয়ে পড়ে এ অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ, ছবিও ছড়িয়ে পড়ে ভস্মীভূত দোকানের। রাতের ছবিতে সবকিছু পুড়ে গেছে দেখা গেলেও সকালে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, না সবকিছু পুড়ে যায়নি বেঁচে গেছে একটি বালাম (রেজিস্ট্রি ভলিউম) বই। আগের রাতের ছবিতে বইটি দেখা না গেলেও এ বালাম বই-ই ঝড় তুলে দেয় সিলেট রেজিস্ট্রি অফিসে।
রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত বইটির এভাবে বাইরে আসার কথা নয়। তদন্ত কমিটি হয়। বিয়ানীবাজার উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার লোকমান আহমদ, বিশ্বনাথ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার খালেদ মোহাম্মদ বিন আসাদ ও জৈন্তাপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মো. আবুল কাশেমের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি কোনো কূল-কিনারা পায় না। রহস্যের কোনো কিনারা করতে না পেরে আরো উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত প্রয়োজন বলে মত দেন তারা। বালাম বইয়ের বাইরে আসার ঘটনায় সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে ভস্মীভূত দোকানের ম্যানেজার নিজাম আহমদ মান্না, দোকান মালিক নাজির আহমদ খান, রেকর্ড কীপার রীনা রায় ও সহকারী রেকর্ড কীপার প্রণয় কান্তি ঘোষকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা (নং-৩০) দায়ের করেন। এ ঘটনায় রেকর্ড কিপার রীনা রায় ও সহকারী রেকর্ড কিপার প্রণয় কান্তি ঘোষকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।
বালাম বই বাইরে বেরিয়ে আসায় সিলেট রেজিস্ট্রি অফিসে তুলকালাম চলছে। বালাম বই কি করে বাইরে বেরিয়ে এলো সে প্রশ্নের যেমন উত্তর মিলছে না, তেমনি রহস্য হয়েই রয়েছে বালাম বইয়ের ‘বেঁচে’ যাওয়াটাও। আগুনে সব কিছু পুড়ে গেলেও বালাম বইটি পুড়লো না কেনো, কিংবা আবার আগুনে বেঁচে গেলেও ফায়ার সার্ভিসের পানির তোড়ের পরও টিকে রইলো কি করে বইটি-এমন প্রশ্ন অনেকেরই মাঝে। এসব প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কারো কারো সন্দেহ অগ্নিকাণ্ডের সময় হয়তো বালাম বইটি ঘটনাস্থলেই ছিল না। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া অগ্নিকাণ্ডের রাতের ও পরের দিনের দুটো ছবি তাদের সে সন্দেহকে বাড়িয়ে তুলছে।
তাদের সে সন্দেহের সুতো ধরে মানবজমিনের সামনে উঠে এসেছে তিনটি নাম। অভিযোগ সিলেট রেজিস্ট্রি অফিসের সকল অনিয়মের হোতা এরাই। সাব-রেজিস্ট্রারসহ সবাই জিম্মি এদের হাতে। এ চক্রটি টাকার বিনিময়ে জমির শ্রেণি বদলিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া, ভলিউম ঘষামাজা, কাটা-ছেঁড়া, দলিলের পাতা খুলে অন্য পাতা লাগানোসহ নানা দুর্নীতি-অনিয়ম করে আসছে। অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও এ সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে।
আলোচিত এ সিন্ডিকেটের কর্ণধার হিসেবে উঠে এসেছে জেলা রেজিস্ট্রারের এক উচ্চমান সহকারীর নাম। ২০০৩ সালের দিকে নিম্নমান সহকারী (টাইপিস্ট) পদে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে সিলেট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বিশেষ ‘দক্ষ’তায় এক বছরের মাথায়ই সকল নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাকরি স্থায়ী করে নিতে সক্ষম হন তিনি। টানা ১০ বছর একই স্থানে চাকরির পর ২০১৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে অফিস সহকারী হিসেবে তাজপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বদলি হন। দু’বছর পর আবার ফিরে আসেন সিলেটে। এবার তিনি আসেন জেলা রেজিস্ট্রারের উচ্চমান সহকারী হিসেবে। তারপরই গড়ে তুলেন নিজের সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন সদর সাব- রেজিস্ট্রারের এক অফিস সহকারীও। আর তাদের দু’জনের হয়ে সব কাজ সামাল দেন অস্থায়ী নকলনবিশ কাজের ক্ষেত্রে হাজিরার প্রমাণ না থাকলেও রাতের ‘বিশেষ’ কাজে ঠিকই হাজিরা দেন তিনি। রোজ রাতে তিনি উপস্থিত থাকেন পূর্ত ভবনের নিচতলার এক চা দোকানে। অভিযোগ, এ রাতের মিশনে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সব অবৈধ কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
অভিযোগ আছে, এ সিন্ডিকেটের যোগসাজশেই আগুন লেগেছিলো নাজির স্ট্যাম্প ভেন্ডারে। কোতোয়ালি থানায় নাজির স্ট্যাম্প ভেন্ডারের ম্যানেজার নিজাম আহমদ মান্নার দেয়া অভিযোগেও বিষয়টিকে অগ্নিসংযোগ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে পূর্ব শত্রুতার কারণেই আগুন লাগানো হয়েছে।
আর এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য বালাম বইটি পরে রেখে দেয়া হয়েছিলো ঘটনাস্থলে, এমন অভিযোগও উঠেছে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
বালাম বইটি পুড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সদর সাব-রেজিস্ট্রার আবু বক্কর সিদ্দিক মানবজমিনকে বলেন, আগুনে সবকিছু পুড়ে গেলেও বালাম বইটি আংশিক পুড়েছে। দলিলের মূল বক্তব্য ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় কপি করে বালাম নতুন করে তৈরি করা যাবে, নকল ওঠানোতে কোনো অসুবিধা হবে না। কি করে বালাম বইটি বাইরে এলো এ বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে না পারলেও তিনি তথ্য দেন যে, রেকর্ড রুমের দরজা জানালা যথেষ্ট সুরক্ষিত না থাকায় দলিলপত্র ভেতরে নিরাপদ নয়। তিনি জানান, রেকর্ড রুমের জানালার গ্লাস ভাঙা, কবুতর ঢুকে পড়ে ভেতরে। সাব-রেজিস্ট্রার বললেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দিয়েও কোনো ফল পাইনি। -সুত্র মানবজমিন