জান নিয়ে বেরোতে পারব কি ?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মার্চ ২০১৭, ২:৪১ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
রাতের পর পুরো দিন পেরিয়ে আবার রাত। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার পাঠানপাড়ার জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে জিম্মি থাকা প্রায় ৩০টি পরিবারের দুই শতাধিক মানুষের ভাগ্যে কী আছে, সেই উৎকন্ঠায় আছেন সবাই। জঙ্গিরা ২য় তলার ৬টি ইউনিটের মধ্যে ২টি ইউনিটের বাসিন্দারের জিম্মি করে রেখেছে। নিচ তলা থেকে জঙ্গিরা উপরে উঠে তাদের জিম্মি করেছে। এমনটি জানিয়েছেন ২য় তলায় থাকা একজন অধ্যাপক। যিনি নিজেও পরিবার নিয়ে জিম্মিদশায় আছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিববাড়ি-পাঠানপাড়া মূল সড়কে পাশাপাশি দুটো বাড়ি। পাঁচতলা বাড়িটির নাম ‘আতিয়া মহল’। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, এ বাড়ির নিচতলায় রয়েছে জঙ্গি। বাড়ির প্রতি তলায় ছয়টি করে ইউনিট। নিচতলা ছাড়া বাকি চার তলায় ২৯টি পরিবার রয়েছে।
নিচতলায় জঙ্গি থাকায় বাকি চারটি তলায় ২৯টি পরিবারের সদস্যরা আটকা পড়েছে। শুক্রবার দুপুরে ও রাত পৌনে আটটায় কথা হয় নজরুল ইসলাম নামে দোতলার একজন বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে একদল পুলিশ গিয়ে বাড়ির মূল ফটক তালাবদ্ধ করে রাখে। ভোরে গোলাগুলির শব্দ শুনে তাঁরা বাইরে মুঠোফোন দিয়ে কল করে জানতে পারেন নিচে জঙ্গি আছে।
বাড়ির তিনতলা ও চারতলায় পুলিশ সদস্যের দুটো পরিবার রয়েছে। জকিগঞ্জ থানার এসআই মুহিবুর রহমান জানান, তাঁর পরিবার বাড়িতে আটকা পড়েছে। তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম জিম্মি করে রাখা হয়েছে। ফোনে যোগাযোগ করে জানতে পারছি, এ রকম কিছু নয়। তবে সবাই ভয়ের মধ্যে আছে। ভবনের দোতলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বেলা দেড়টার দিকে মুঠোফোনে জানতে চান, তাঁরা জিম্মি কি না। রাত পৌনে আটটার দিকে নজরুলকে ফের ফোন করলে তিনি জানান, ঘরে খিল এঁটে বসে আছেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তিনি জানতে চান, ‘আমরা কি জিম্মি? জান নিয়ে বেরোতে পারব কি?’
পাঠানপাড়ার বাসিন্দা ছয়েফ খান জানান, বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে পুলিশের মাধ্যমে জেনেছেন ওই বাড়িতে জঙ্গি আছে। এরপর থেকে আশপাশের প্রায় দুই শতাধিক বাড়ির মানুষ উদ্বিগ্ন। সারা দিন বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বিদ্যুৎ এসেছে।
আতিয়া মহলের প্রধান ফটকে তালাবদ্ধ করেছিলেন দক্ষিণ সুরমা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন দাশ। শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় শিববাড়ির রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে স্বপন বলেন, ফটক তালাবদ্ধ করার সময় পুরো ভবনে কোনো ধরনের সাড়া শব্দ ছিল না। ভোর পৌনে ছয়টার দিকে নিচ তলার একটি জানালা খুলে বাইরে হাত বোমা ফেলায় সশস্ত্র জঙ্গিদের অবস্থান নিশ্চিত হন তারা।
আতিয়া মহলের বিপরীত দিকে আছে একই মালিকের আতিয়া-২ নামের চারতলা আরেকটি বাড়ি। সেটির বাসিন্দা ১৭টি পরিবারের ৭০ জন সদস্যকে সকাল সাড়ে আটটার দিকে বের করে পাশে জহির-তাহির মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে রাখে পুলিশ। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ৭০ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে আত্মীয়দের বাসায় রাত্রিযাপন করার নির্দেশ দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ে প্রায় পুরো দিন অভুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথমে বলা হয়েছিল আটক। পরে বলা হয় নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে ছেড়ে দেওয়ার পর অনেকটা বিপাকে পড়ি।’ অনেকেই দক্ষিণ সুরমার কদমতলী এলাকায় আবাসিক হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে আতিয়া মহলের পেছনে পুকুরপাড়ে বসে হ্যান্ড মাইক দিয়ে জঙ্গিদের নাম ধরে ডাকছিলেন জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন। তিনি জানান, বাড়ির মালিকের ভাড়াটেদের তথ্যে জানা যায়, মর্জিনা বেগম নামে একজন নিচতলা ভাড়া নিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নারী জঙ্গিও আছে। তাই মর্জিনার নাম ধরে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছিল।
বেলা একটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত বাড়ির পেছনে অবস্থান নিয়ে দেখা গেছে, বেলা একটা ১৬ মিনিটের সময় আত্মসমর্পণের আহ্বানে একজন সাড়া দিয়ে বলেন, ফোর্স পাঠান। শিববাড়ির মন্দিরের কাছ থেকে হ্যান্ড মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো পুলিশের উপপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, ‘দুইটা ১০ মিনিটে নিচতলার জানালা ফাঁক করে একজন পুলিশকে বলেন, সোয়াত পাঠান।’
বিকেল চারটায় সোয়াত সদস্যরা বাড়ির চারদিকে গেলে ওসি আখতার হোসেন আবার মাইক দিয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থেকে থেমে অন্তত সাতবার আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। কিন্তু আর কোনো সাড়া মেলেনি। একপর্যায়ে ওসি আখতার হ্যান্ড মাইকে উচ্চ কণ্ঠে বলেন, ‘মর্জিনা ও আপনার স্বামীকে বলছি। আপনারা দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেন। ঘরের জানালা খোলেন। এভাবে কথা না বলে থাকা ঠিক না। প্লিজ কথা বলেন। আপনাদের কথা মতো সোয়াত এসেছে।’ এরপরও সাড়া মেলেনি।
রাত আটটার দিকে মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া শিববাড়ি মোড়ের রাস্তার কাছে সাংবাদিকদের বলেন, অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সোয়াত টিমের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যদের একটি দল অংশ নিয়েছে। বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অভিযান সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সবকিছু আমাদের অনুকূলে আছে। আশা করছি শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হব।’
ঢাকা-চট্টগ্রামের ওই অভিযানের পর আটক জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শিববাড়ি এলাকার পাঁচতলা বাড়িটি ঘিরে রাখেন সিলেটের স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা।
এরপর ওই বাড়ির মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেন তাঁরা। আজ ভোরে ভেতরে থাকা জঙ্গিরা গ্রেনেড চার্জ করে বলে স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়। পুলিশও কয়েক দফা গুলি ছোড়ে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার পাঠানপাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত পাঁচতলা ও চারতলা বিশিষ্ট দুটি ভবনের নাম আতিয়া মহল। সিলেট নগরীর আতিয়া ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির বান্দরঘাটের (বন্দরঘাট) বাসিন্দা উস্তার মিয়া।
গত জানুয়ারি মাসে প্রাণ কোম্পানির অডিট অফিসার পরিচয়ে কাওসার আহমদ ও মর্জিনা বেগম ওই বাড়ি ভাড়া নেন বলে জানিয়েছেন বাড়ির মালিক।