আয়নাবাজি সিনেমায় ভালো কিছু শেখার নেই, বরং খারাপ কিছু শেখার আছে
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ অক্টোবর ২০১৬, ৬:০৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বিজ্ঞাপন নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী পরিচালিত ‘আয়নাবাজি’ গত ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটি শুরু থেকেই আলোচিত। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মত উঠে এসেছে। যদিও শহুরে তরুণ সিনেমাপ্রেমীদের কাছে আয়নাবাজি বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
সিনেমাটি প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে চিত্রনায়ক কাজী মারুফ গণমাধ্যমকে জানান, ‘এ সিনেমায় ভালো কিছু শেখার নেই ।’ সিনেমাটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সিনেমা হলো সমাজের আয়না, আয়নাবাজি কি সমাজের আয়না? সমাজে যা কিছু ঘটে তাই সিনেমায় দেখানো হয়। এতে মানুষ সচেতন হওয়ার অবকাশ পায়। খারাপ ত্যাগ করে ভালোটা গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত হয় দর্শক। সে কারণেই বলছি, আয়নাবাজি দেখে মানুষ খারাপটা গ্রহণ করলে অবাক হবো না।’
আপনি তাহলে কেন সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অমিতাভ রেজার সিনেমা বলেই আমি দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি যথেষ্ট প্রতিভাবান। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আমরা তার বেশ কিছু ভালো কাজ দেখেছি। যে কারণে একটা কৌতূহল কাজ করছিল।’ শহরের তরুণ প্রজন্ম কিন্তু আয়নাবাজি দেখছে। চারিদিকে সিনেমাটি নিয়ে একটি রব উঠেছে। তাহলে এর কারণ কী বলে মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে কাজী মারুফ বলেন, ‘বুঝতে হবে গ্রে নামক একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা এ সিনেমার সঙ্গে জড়িত। তাদের টাকার অভাব নেই। গ্রে যাদের পাবলিক রিলেশনের কাজ করবে তাদের তো জয় জয়কার হবেই।’
এর আগে চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত ‘মনপুরা’ সিনেমাটিও সুপার হিট হয়েছে? তাহলে কী বলা যায় যে, চঞ্চলের অভিনয়ের কারণেই এই জয় জয়কার? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আয়নাবাজি চঞ্চলের জন্য চলেনি। এটা চলেছে অমিতাভ রেজার জন্য। তারপরও একটি মহলের জন্য কিন্তু এটি ভালো সিনেমা। তবে সকল মহলের জন্য এটি ভালো সিনেমা নয়। সাতক্ষীরাসহ গ্রামঞ্চলে আয়নাবাজি ভালো যায়নি। শুধু শহর এলাকায় ভালো চলেছে। অমিতাভ রেজা আর একটা এ ধরনের সিনেমা নির্মাণ করে দেখুক কতটা ভালো চলে! আর সিনেমাটি যতটা ভালো চলছে বলা হচ্ছে আসলে কী তাই? কয়টা সিনেমা হলে আয়নাবাজি চলেছে? এটা কী ‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’র মতো চলেছে কিংবা ‘লাভ ম্যারেজ’ সিনেমার মতো গ্রাম-বাংলায় দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে? আয়নাবাজি তা কিন্তু এখনও পায়নি। মূল কথা হচ্ছে, দেশের মানুষের প্রতি একজন পরিচালকের দায়বোধ কাজ করে। অমিতাভ রেজারও একটা দায়িত্ব ছিল। যেহেতু সে ভালো বিজ্ঞাপন নির্মাতা।’
বর্তমান সময়ের সিনেমার দর্শক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মূল ধারার সিনেমা কমপক্ষে ৫০টি হলে মুক্তি পায়। আর যে সব হলে মুক্তি পায় এসব হলে একটা শো হাউজ ফুল হতে ১১শ লোক লাগে। চারটা শো ফুল হতে ৪ হাজার ৪ শত লোক লাগে। যদি পঁচিশটা হল একদিনে ফুল হয় তবে ১ লাখ ১০ হাজার লোক এক দিনে সিনেমাটি দেখে। আর এসব দর্শক ফেসবুক চালাতে পারেন না। সিনেমা ভালো কি মন্দ হলে ফেসবুকে লিখতেও পারে না। অন্যদিকে সিনেপ্লেক্সে একটি শো ফুল হতে ২৫৬ জন লোক প্রয়োজন। তা হলে দেখেন ওদের এক শো সিনেপ্লেক্সের পাঁচ শোর সমান। এত ভালো যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত ৫০-৬০টি হলে চলে হয়তো। একই সময় একশ হলে আয়নাবাজি চলুক তখন বলা যাবে কতটা ভালো যাচ্ছে। নিয়মিত যারা সিনেমা নির্মাণ করেন তাদের সিনেমা ৫০টির কম প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে তারা অসন্মানিত বোধ করে।’
এটুকু বলেই কাজী মারুফ উল্টো আয়নাবাজি দেখে যারা ভালো ভালো বলে গলা ফাটাচ্ছেন তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখেন। সেগুলো যথাক্রমে:
এক. সিনেমার হিরো চঞ্চল চৌধুরী প্রথম এন্ট্রিতে বাজারের লোককে ঠকিয়ে মাছ নিয়ে আসেন। তাহলে কি আমরা মানুষকে ঠকিয়ে খাব?
দুই. মামলার ধরণ শুনে ভাড়ায় জেল খাটেন হিরো। প্রথম যে মামলার আসামীর পরিবর্তে নায়ক জেলে গিয়েছেনে সেটা হলো নারী নির্যাতন মামলা। নায়কের কি নারী নির্যাতন মামলা ভালো লেগেছে যে তিনি সেটাতে রাজী হয়েছেন?
তিন. জেলের ভেতর কোন ধরণের গান-বাজনা হয়? বাংলাদেশের কোনো সিনেমায় জেলের ভেতরে গান-বাজনা দেখানো হয় না। আর হলেও স্যাড গান হয়। অথবা কল্পনায় গান গাওয়া হয়।
চার. জেলের কয়েদির গাড়ি কি কখনো কোথাও থামে?
পাঁচ. আয়নাবাজির মতো সিনেমা আমরা নির্মাণ করলে সেন্সর ছাড়পত্র পেত না। আমরা ‘সর্বনাশা ইয়াবা’ নির্মাণ করেছি। সেন্সর বোর্ড বলেছে, ‘ইয়াবা খাওয়ানো দেখানো যাবে না।’ আমরা যা টুকটাক দেখিয়েছি তাতে আমরা লিখে দিয়েছি ‘মাদক স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর’। কিন্তু এ সিনেমায় প্রকাশ্যে মদ পান করছেন কিন্তু কোথাও লেখা ছিল না ‘মাদক স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর’। তাহলে দর্শক কী শিখবে? মদ খাওয়া সাস্থের জন্য ভালো?
ছয়. সাংবাদিকদের সমাজের বিবেক বলা হয়। এখানে সাংবাদিককে মদ পান করতে দেখানো হয়েছে। এছাড়া সঠিক খবর প্রকাশ করতে পারেনি সে। এখানে সাংবাদিকদের নীতিগতভাবে ছোট করা হয়েছে।
সাত. আমাদের বস্তা পঁচা বাংলা সিনেমায় ভিলেনের কোনো রেহাই নেই। কিন্তু যদি হিরো অন্যায় করেন তাকেও শেষে মেরে ফেলা হয়। তারও মৃত্যু ঘটে। তারও জেল হয়। জেল হওয়ার পরও বাঁচিয়ে রাখার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ সিনেমার হিরো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অন্যায় করে গেছেন। ক্রাইম করেছেন। এই ক্রাইমের কী সাজা হয়েছে? বরং অন্যায় করেও পার পেয়ে হাসছেন। তার মানে তিনি আবারও এ অন্যায় করবেন। তার মানে কী আমরা ক্রিমিনালকে উৎসাহ দিচ্ছি?
আট. আয়নাবাজিতে পুলিশকে বোকা বানানো হয়েছে। পুরো সিনেমায় পুলিশ বোকা। বাংলাদেশের পুলিশ কি এতটাই বোকা! সাধারণ মানুষ এখান থেকে পুলিশ সম্পর্কে কী ধারণা পাবে? যেখানে জঙ্গিবাদ একটা বড় ইস্যু সেখানে পুলিশকে বোকা বানানো কতটা যুক্তিসঙ্গত?
নয়. সিনেমার হিরোর মা যাত্রা দলে অভিনয় করতে পছন্দ করেন। তাই নায়কও অভিনয় করেন বিভিন্ন বেশে। মা অসুস্থ ছিল বলে ভাড়ায় জেল খেটে টাকা রোজগার করে সে। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে যখন সে দেখে মা মারা গেছে। তাহলে তো তার আর অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন নেই। যেহেতু তার আরেকটি স্কুলের চাকরি আছে। সুতরাং তার আর এ কাজ করাই উচিত না। একদম শেষ দিকে যখন সে ফাঁসির প্রহর গুণছে তখনও প্রেমিকার সঙ্গে সে অভিনয় করেই যাচ্ছে-এটা কতটা বাস্তবসম্মত? অর্থাৎ অভিনেতা অন্যায় করেই যাচ্ছেন। তার মানে অভিনেতারা এভাবে অন্যায় করেন? এখানে অভিনেতাদেরও অসন্মান করা হয়েছে। শুরু থেকে অন্যায় করেই যাচ্ছে কিন্তু আয়নার কোনো অনুশোচনা হয়নি।