দুই পুত্র হত্যার নির্মম বর্ণনা ছাতির মিয়ার মুখে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০১৬, ১:১৪ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
খুনের ঘটনার আগের দিনই সুপারি গাছের গুঁড়ি কেটে ধারালো সুরকি তৈরি করে ছাতির মিয়া। তখন পরিবারের
সদস্যরা জিজ্ঞেস করেছিলেন- সুরকি দিয়ে কী করবেন। ছাতির মিয়া বলেছিলেন- সুরকি দিয়ে মাছ ধরবেন। আর ওই সুরকি দিয়েই হাওরের নির্জন স্থানে পুত্র রুজেল ও মামুনকে খুন করে ছাতির মিয়া।
ওসমানীনগরের চিন্তামনি গ্রামে দুই পুত্রের হন্তারক পিতা ছাতির মিয়াকে গতকাল সকালে জনতার সহায়তায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ছাতির মিয়া এসব তথ্য জানিয়েছে। বলেছে, এগারো বছরের বড় ছেলে রুজেল মিয়াকে মাছ দিয়ে বাড়ি পাঠায়। আর এই সুযোগে হাওরের নির্জন স্থানে সে ৮ বছরের শিশুপুত্র মামুন মিয়াকে খুন করে। সুপারি গাছে গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা সুরকি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সে মামুনকে খুন করে হাওরের ডোবায় লাশ চুবিয়ে রাখে। আর ওদিকে, বড় ছেলে রুজেল মিয়া বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি মাছ দিয়ে হাওরে চলে যায়। যাওয়ার সময় মাকে বলে-‘বাবা বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে। নতুবা বাবা মারধর করবে।’ এ কথা বলে দ্রুত হাওরে চলে যায়। আর রুজেল ফিরে যাওয়ার পর ঘাতক পিতা ছাতির মিয়া সুরকি দিয়ে তার মাথার পেছন দিকে পরপর কয়েকটি আঘাত করে। এ কারণে রুজেলের মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে যায়। এরপর রুজেলে লাশও ডোবার মধ্যে চুবিয়ে রেখে সে পালিয়ে যায়। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ছাতির মিয়া জানিয়েছে, খুনের ঘটনার পর পরই সে গ্রামের কালিমন্দিরের পাশের নির্জন জঙ্গলে অবস্থান নেয়। এবং সেখানেই সে গত দুই দিন কাটিয়েছেন। এই দুই দিন সে বের হয়নি। কোনো কিছুই খায়নি। গতকাল ভোরে ছাতির মিয়া ওই জঙ্গল থেকে রাস্তায় বের হলে স্থানীয় লোকজনের চোখে পড়ে। এরপর সে জঙ্গলে চলে যায়। ওখানে গিয়ে একটি নির্জন স্থানে সে শুয়ে পড়ে। পরে গ্রামের লোকজন ওখান থেকেই তাকে আটক করে। এরপর ছাতির মিয়াকে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। ছাতির মিয়ার স্বজন চিন্তামনি গ্রামের ফারুক মিয়া জানিয়েছেন, আটকের পর ছাতির মিয়াকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। এ সময় গ্রামের লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। তবে, তাকে আটকে রেখে প্রথমে কিছু খাবার দেয়া হয়। তিনি জানান, আটকের পর তার সঙ্গে গ্রামের কেউ কথা বলেননি। ওসি থানা থেকে আসার পূর্ব পর্যন্ত তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে সে পালাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখেন এলাকাবাসী। পরে ওসমানীনগর থানা পুলিশের একটি দল গিয়ে ছাতির মিয়াকে আটক করে নিয়ে আসে। আটকের পর পরই ছাতির মিয়াকে নিয়ে আসা হয় সিলেটের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। ওখানে ছাতির মিয়াকে সঙ্গে নিয়েই প্রেস ব্রিফিং করেন পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান। প্রেস ব্রিফিংকালে ছাতির মিয়া অনেকটা নির্বাক ছিল। ওসমানীনগর থানার ওসি আবদুল আউয়াল চৌধুরী তাকে ধরে রাখেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার জানান, স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর ছাতির মিয়া একাই তার দুই সন্তান রুজেল ও মামুনকে খুন করেছে বলে স্বীকার করেছে। সুপারি গাছের গুঁড়ি দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা ধারালো সুরকি দিয়ে সে এক এক করে ধরে দুই পুত্রকে হত্যা করেছে। কী কারণে হত্যা করা হয়েছে সেটি এখনও জানা যায়নি। পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার পর তিনি এবং জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল ও চিন্তামনি গ্রামে গেছেন। তারা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় তারা ধারণা পেয়েছেন- স্ত্রী নুরমনির সঙ্গে পারিবারিক বিরোধ ছিল ছাতির মিয়া। সে স্ত্রীকে সন্দেহ করতো। আর এই সন্দেহের কারণে তাদের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ ছিল। এই বিরোধের কারণে তার স্ত্রী পিত্রালয়ে ছিল। স্বামীর বাড়ি ফিরেছেন ২০ দিন হলো। এই ২০ দিন ছাতির মিয়া স্ত্রী নুরমনির হাতের রান্না খাননি বলে পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন। তবে, পুলিশ সুপার বলেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ তদন্ত করে বের করা হবে। পাশাপাশি ছাতির মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করা হবে। ব্রিফিংকালে পুলিশ সুপার বলেন, এখনও মামলা হয়নি। শোকাহত পরিবারের সদস্যরা দ্রুত এজাহার দাখিল করবেন। এরপর মামলায় ছাতির মিয়াকে আদালতে হাজির করা হবে। আদালতে সে জবানবন্দি দিতে চাইলে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে, প্রেস ব্রিফিংয়ের পর ছাতির মিয়াকে ওসমানীনগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে ছাতির মিয়াকে রেখে পুলিশ আরো জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানিয়েছেন সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা। এরপর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। সুজ্ঞান চাকমা বলেন, পুলিশ ঘটনাটি সিরিয়াসলি নিয়েছে। দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। এদিকে, পুলিশ গতকাল সকালে ছাতির মিয়াকে আটকের পর তার দেয়া তথ্য মতে পুলিশ চন্ডির হাওর থেকে সুপারির গাছের সুরকি, দুটি বউল উদ্ধার করেছে। এগুলো মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে বলে জানান এডিশনাল এসপি। তিনি জানান, পরিকল্পিতভাবে ছাতির মিয়া তার দুই সন্তানকে খুন করেছে। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছেন, নুরমনি ও ছাতির মিয়ার বিয়ের পর থেকে বেশ ভালোই চলছিল সংসার। পেশায় কৃষিকাজ করা ছাতির মিয়া কয়েক বছর ধরে স্ত্রীকে সন্দেহ শুরু করে। অন্যজনের সঙ্গে স্ত্রীর পরকীয়া রয়েছে বলে তিনি ধারণা পোষণ করেন। আর এই ধারণা থেকেই তাদের পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। এজন্য কয়েক বছর ধরে স্ত্রীকে মারধর করতেন ছাতির মিয়া। কখনও ঘরে থাকা বটি দা দিয়ে বউকে দৌড়াতেন। স্বামীর এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন নুরমনি। এ কারণে প্রায় দুই মাস আগে তিনি সন্তানদের নিয়ে পিতার বাড়ি গিয়েছিলেন। এরপর সালিশের মাধ্যমে খুনের ঘটনার প্রায় ২০ দিন আগে নুরমনিকে ছাতির মিয়ার সংসারে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু নুরমনিকে বাড়ি নিয়ে এলেও তার হাতের রান্না খেতেন না স্বামী ছাতির মিয়া। এমনকি তাদের মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ ছিল।- মানবজমিন