রাগীব আলীর সাম্রাজ্যে ধস : মধুবন মার্কেটও হারানোর আশঙ্কা!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:০৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
দানবীর বনে যাওয়া রাগিব আলীর একের পর এক সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তিলে তিলে গড়ে তোলা অবৈধ সাম্রাজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে রাগিব আলী। পালিয়ে গিয়েও রেহাই হচ্ছে না। ক্রমেই হাতছাড়া হচ্ছে একের পর এক স্থাপনা। আর তাতেই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন দানবীর বনে যাওয়া রাগিব আলী। তারাপুর চা বাগান হারিয়েছেন। হারিয়েছেন ১৭৫টি স্থাপনাও।
এবার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে রাগীর আলীর দখলকৃত পাইলট স্কুলের ছাত্রাবাসের জায়গা মধুবন মার্কেট। এখন বুঝি মার্কেটের স্থাপনাটিও হারাতে যাচ্ছেন কথিত এই ‘দানবীর’।
তবে এতোদিন অবৈধভাবে বিক্রি করা বাগানের ভূমিতে গড়ে ওঠা স্থাপনা রক্ষায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত এক জোট হয়ে মানবন্ধন, সভা-সমাবেশ করেছেন। কিন্তু ভাগ ফল হয় শূন্য। অবৈধ দখলে নিয়ে বিক্রিত রাগির আলীর ১৭৫টি স্থাপনা সেবায়েতকে বুঝিয়ে দিলো।
একাত্তরের শহীদ পরিবারের সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান জালিয়াতি করে আত্মসাত করেছিলেন রাগীব আলী। অবৈধ সম্পদ দখলে রেখে তিনযুগের বেশি সময় ধরে দেশে দানবীর খেতাবে ভুষিত হয়ে আসছিলেন তিনি। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাগীব আলী ওয়ান ইলেভেনের সময় পালিয়ে লন্ডনে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার।
আদালতের রায়ে প্রতিয়মান হয় ‘দানবীর’ হওয়ার নেপথ্যের কাহিনী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগানে প্রতারণার মাধ্যমে লিজ নিয়ে বাগান ধ্বংস করে হাউজিং প্রকল্প ও নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন রাগিব আলী। ১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তারাপুর চা বাগানসহ তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউর দেবতার নামে রেজিস্ট্রিমূলে দলিল করে দেন। তখন থেকেই সম্পত্তিটি দেবোত্তর সম্পত্তি।
বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত এ দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত নিযুক্ত হন। এর আগে বাগানটি তৎকালীন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত জনসন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ১৯৭১ সালে সেবায়েত রাজেন্দ্র গুপ্তকে স্বপরিবারে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। পরে বিমানবন্দর সড়কের মালনীছড়ায় তাদের মরদেহ পাওয়া যায়। সে হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যান রাজেন্দ্র পুত্র পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থে এ তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।
বাবার মৃত্যুর পর ছাত্রবস্থায় পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বাগানের সেবায়েত মনোনীত হন। ডাক্তারি পড়াশোনা শেষে পঙ্কজ যখন পেশায় নিযুক্ত, তখন এরশাদের শাসানামল। পঙ্কজ চলে যান ভারতে। তখন কথিত পাওয়ার অব এটর্নি মূলে দেবোত্তর সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান রাগিব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দেওয়ান তৌফিক মজিদ লায়েকের সহোদর দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। তিনি রাগিব আলীর ছেলে আবদুল হাইকে বাগানটি ৯৯ বছরের লিজ প্রদান করেন।
শুধু পাওয়ার অব এটর্নি জালিয়াতি নয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মির্জা ফজলুল করিমের স্বাক্ষর জাল করে ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদান করা হয় তারাপুর চা বাগান (ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ভূঃ মঃ/শা-৮/খাজব ৫৩/৮৯)। প্রতারণার মাধ্যমে ভূ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাগিব আলীর বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা (নং-১১৭/০৫) করেন তৎকালীন সিলেট সদর ভূমি কমিশনার এসএম আবদুল কাদের। কিন্তু স্বৈরশাসনকালে বিশেষ মহলের চাপে বাগানের সেবায়েত হস্তান্তর করে নেয়া হয়। তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসন ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। মূলত; তারাপুর চা বাগান হস্তগত হওয়ার পর থেকেই রাগীব আলীর দানবীর বনে যাওয়া।
এর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানকে ম্যানেজ করে অবিক্রয়যোগ্য সিলেট পাইলট হাইস্কুলের ছাত্রাবাস কিনে নেন রাগিব আলী। তৎকালীন সময়ে বহুতল মধুবন মার্কেট নির্মাণ শুরু করলে আন্দোলনে নামেন সিলেটের সচেতনমহল। কিন্তু বিদ্যালয়ের ভূমি পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হন তারা। এমন সময়ে স্থানীয় দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার মালিকানা কিনে নিলে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাগীব আলীকে।
এছাড়াও নগরীর কালীঘাট এলাকায় আখড়ার ভূমি, আম্বরখানায় সিলেট জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ঔষধ ডিপোর ভূমিসহ অনেক ভূমি কৌশলে দখলে নেন রাগীব আলী। বর্তমানে বাংলাদেশের বিখ্যাত লাক্কাতুরা ও মালনীছড়া চা বাগান ন্যাশনাল টি কোম্পানির লীজ গ্রহীতা তিনি।
লাক্কতুড়া বাংলোর আলিশান ভবনেই ছিল তার বসবাস। সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়ে তারাপুর চা বাগান হতে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সরিয়ে নেয়া, তারাপুর চা বাগানের অংশ বিশেষে মেডিকেল কলেজ, আবাসিক প্রকল্প এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে সম্পত্তির ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, এ বাগানকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়াসহ ১৭টি নির্দেশ দিয়ে রায় প্রদান করেছেন।