গ্রেফতার এড়াতে সিলেটের দুই রাঘব বোয়াল লন্ডনে !
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০১৬, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ
জুবায়ের আহমদ:
গ্রেফতার এড়াতে সিলেটের দুই রাঘব বোয়াল হারিস চৌধুরী ও রাগিব আলী এখন লন্ডনে রয়েছেন। বিশ্বস্থ সুত্রে জানা যায়, হারিস চৌধুরী লন্ডনের বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটসে কিছুদিন অবস্থান করেন, পরে এ খবর ছড়িয়ে পরলে তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চলে তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। অপর দিকে গ্রেফতারী পরোয়ানার একদিন পরই ভারতে পালিয়ে যাওয়া রাগিব আলী উঠেছেন পুর্ব লন্ডনের একটি বাসাতে। সেখানে বাঙ্গালী কমিউনিটি নেই বললেই চলে। নিজেকে নিরাপদ রাখতেই তার পুর্ব পরিচিত এক ইংলিশ বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন সিলেটের আলোচিত সমালোচিত কথিত এই দানবীর।
হারিছ চৌধুরীঃ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণের আলোচিত সমালোচিত ব্যক্তি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ভারত থেকে তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। লন্ডন থেকে ইরানে যান তাঁর ভাই আবুল হাসনাত চৌধুরীর কাছে। ইরান থেকে মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে বর্তমানে লন্ডনে আছেন । নয় বছর ধরে পুলিশের খাতায় পলাতক হারিছের ওয়ান ইলেভেনের সময় দুদকের করা শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় নাম ছিল উপরের দিকে। বিএনপি আমলে দেশের প্রভাবশালী এই ব্যক্তি বর্তমানে লন্ডনে আছেন বলে দাবি করেছে একটি ঘনিষ্টসূত্র। ২০০৭ সালে দুদকের তালিকাতে নিজের নাম দেখার পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হারিছ চৌধুরী। ২০১৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারির গ্রেনেড হামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী হওয়ায় সহসাই দেশে ফিরছেন না হারিছ চৌধুরী এমন ধারণা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দের। অবৈধ প্রভাব আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ‘সিনেমাটিক’ জীবন যাপন করেছেন পলাতক হারিছ চৌধুরী। তার রাজকীয় জীবন যাপনের গল্প এখনো ফিরে মানুষের মুখে মুখে। তবে এখন আর সেই দিন নেই। নেই হারিছ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ির সেই চালচলন। এখন অনেকটাই ফাঁকা বলা যায় বাড়িটি। ঢাকা থেকে সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাটের বাড়িতে হারিছ চৌধুরী আসা-যাওয়া করতেন হেলিকপ্টারে। গ্রামে অবস্থানকালে প্রভাবের জোরে অনেক অভাবই দূর করেছেন এই পলাতক নেতা। তিনি গ্রামে যখন থাকতেন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো না মুহূর্তের জন্যও। ঘরের পাশেই পোস্ট অফিস, কৃষি ব্যাংক, মডেল স্কুল, তফশিল অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, এমনকি পুলিশ ফাঁড়িও স্থাপন করিয়েছিলেন। কাঁচা রাস্তার গ্রামে শুধু তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটি ছিল পিচঢালা। বাড়ির ভেতর নির্মাণ করা হয়েছিল নজরকাড়া বাংলো, ছিল চিড়িয়াখানাও। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার দুটি মামলা, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকান্ডে বিস্ফোরক আইনের মামলা ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলারও আসামি ও হারিছ। হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগে কমপক্ষে ছয়টি মামলা হয়েছে। কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার সংলগ্ন দর্পনগর গ্রামে তাঁর মূল বাড়ি। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ার আগে পর্যন্ত ঢাকার বিজয়নগরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গুলশানে কেনেন চারটি বাড়ি। অস্ট্রেলিয়া ও লন্ডনে কেনেন একাধিক ফ্ল্যাট। অবশ্য গুলশানের চারটি বাড়ির মধ্যে একটি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নামে বরাদ্দ নিয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। দুদকে মামলা হওয়ার পর হারিছের পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়িটি ফেরত দেওয়া হয় ২০১৪ সালে। ঢাকার হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে ওঠা হারিছ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দিকেই আত্মগোপন করেন। এক মাসের বেশি সময় হবিগঞ্জে আত্মগোপনে থাকার পর সিলেট শহরে অবস্থান নেন। তখনই দুর্নীতি দমন কমিশনের শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় তাঁর নাম উঠে আসে। একপর্যায়ে ২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মামাবাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে চলে যান। তাঁর চাহিদা মতো দরকারি কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ স্বজনরা বস্তায় ভরে সীমান্তপথে ভারতে তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়। ঢাকার নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে ১৯৭৭ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে জাগদলে যোগ দেন। সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতিসহ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে সর্বশেষ কাউন্সিলে বিএনপির কোনো পদেই রাখা হয়নি হারিছকে। দেশে ফিরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে তাঁর নাম থাকায় দেশে ফেরার পরিকল্পনা বাদ দেন তিনি। ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আবুল হাসনাত চৌধুরী ঢাকায় মারা যান। তখন হারিছ ইরানে অবস্থান করছিলেন। গত নির্বাচনের আগে সিলেট-১ আসনে হারিছ চৌধুরীকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়ে পোস্টারিংও করা হয়েছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন হারিছ। তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ায় পরাজয়ের সব গ্লানি মুছে যায়। হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জোসনা আরা বেগম, ছেলে নাঈম সাফি চৌধুরী ও মেয়ে সামিরা তানজিম (মুন্নু আরা)। মেয়ে ব্যারিস্টার ও ছেলে নরওয়েভিত্তিক একটি তেল কম্পানিতে কাজ করছেন। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের আগে হারিছের সঙ্গে দেখা করতে স্ত্রী-সন্তানরা ঢাকায় এসেছিলেন। হারিছের ইচ্ছা ছিল জাতীয় নির্বাচনে দেশে এসে প্রার্থী হবেন। তবে বিএনপি থেকে কোনো সংকেত মেলেনি। হারিছের চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচন হলে কানাইঘাট-জকিগঞ্জ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কাহের চৌধুরী মনোনয়ন পেতে পারেন। আমি নিজেও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
রাগিব আলীঃ সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট তথা দেশের সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত নাম রাগিব আলী। জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ভূমি আত্মসাৎ ও প্রতারণার আলোচিত দুটি মামলায় গ্রেফতারী পরয়োনা জারি করা হয় তার বিরুদ্ধে। একদিন পরই জকিগঞ্জ আওয়ামীলীগের এক নেতার সাহায্য ভারতে পালিয়ে যাওয়া রাগিব আলী। সেখান থেকে গ্রেফতার করে দেশে আনা হতে পারে এমন খবরে দ্রুত লন্ডনে পাড়ি জমান রাগিব আলী ও তার পরিবারের বাকি সদস্যরা। জানা যায়, যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে রাগীব আলী ও তার ছেলের। এজন্য তারা এখানেই তিনি গন্তব্য ঠিক করেছেন। আর যুক্তরাজ্যে চলে আসায় বাংলাদেশের পুলিশ চাইলেও এখান থেকে সহজে তাদের দেশে ফেরত নিতে পারবে না।
উল্লেখ্য যে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলায় রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অন্যদিকে প্রতারণার মামলায় রাগীব আলী, তার ছেলে আবদুল হাই, জামাতা আবদুল কাদির, মেয়ে রুজিনা কাদির, রাগীব আলীর আত্মীয় মৌলভীবাজারের দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, তারাপুর চা বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির খবর পেয়েই, গ্রেফতার এড়াতে ওইদিনই তড়িগড়ি করে রাগীব আলীর তার ছেলে আবদুল হাই, ছেলের স্ত্রী সাদিকা জান্নাত এবং জামিলুর রহমান, সাঈদ আহমদ, কামরুল হাসান ও জাহিদুল ইসলাম নামক চার ব্যক্তিসহ ভারতে পালিয়ে যান। সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে, কুশিয়ারা নদী পার হয়ে ভারতে পলায়ন করেন রাগীব আলী। তার এই পলায়ন সংবাদ সর্বপ্রথম ‘ব্রেক’ করে। এরপরই সিলেটজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। প্রসঙ্গত, ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জায়গার উপর তারাপুর চা বাগান পুরোটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। আশির দশকে জালিয়াতির মাধ্যমে এটি দখলে নেন রাগীব আলী। এ নিয়ে চলা মামলার প্রেক্ষিতে আদালতে একটি রিট পিটিশনের ভিত্তিতে গত ১৯ জানুয়ারি তারাপুরে রাগীব আলীর দখলদারিত্বকে অবৈধ ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।