সুনামগঞ্জের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে নেই মেডিকেল অফিসার
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুন ২০১৯, ৩:৩০ অপরাহ্ণ
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ইউনিয়নের ৩০ হাজার মানুষের জন্য একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অথচ গত প্রায় ৩ বছর ধরে একমাত্র উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ছাড়া আর কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী’র পদায়ন হয়নি উক্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বাকি সব পদ শূন্য।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হাওর-বাওর বেষ্টিত এই জেলার বেশিরভাগ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এমন দশা। জেলায় ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ২২ টি এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৫৪ টি, সব মিলিয়ে ৭৬ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এরমধ্যে ৪ টিতে মেডিকেল অফিসার (এমবিএস ডাক্তার) পদায়ন থাকলেও ৩ জন ডাক্তার সংশ্লিষ্ট উপজেলা সদর হাসপাতালে কাজ করছেন, অন্য একজন প্রায় আড়াই বছর হয় বিনা অনুমতিতে আয়ারল্যান্ডে আছেন। অর্থাৎ জেলার কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই ডাক্তার নেই।
দোয়ারাবাজারের লক্ষীপুর ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ছাড়াও উপজেলার ভোগলা ও সুরমা এবং সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের একাংশের বাসিন্দারা এখানে জরুরি চিকিৎসা নিতে আসেন। লক্ষীপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশের বাড়ি’র একজন গৃহিনী নিজের পরিচয় না দেবার অনুরোধ করে বললেন, ‘কয়েকদিন আগে (মধ্য রমজানে) আমার তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া শিশু কন্যাকে জ্বর ও ডায়রিয়ার ওষুধ দেবার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম, ভিজিটর আপা বলে দিয়েছেন প্যারসিটামল ছাড়া আর কিছুই নেই, ৩ টা প্যারাসিটামল হাতে তুলে দিয়ে, জ্বর থাকলে তিনবার তিনটা খাওয়ার জন্য বলে দেন এবং বাজার থেকে স্যালাইন এনে খাওয়ার জন্য বলেন।’
লক্ষীপুরের পাশের এরোয়াখাই গ্রামের আব্দুর রহিম জানালেন, উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারকে অফিস সময়েই ভিজিট দিয়ে রোগী দেখাতে হয়। অফিস সময়ে বাইরে রোগী দেখতেও যান তিনি।
লক্ষীপুর গ্রামের সন্তান সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, ‘লক্ষীপুর ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। সিলেট জেলা পরিষদ এর তত্ত্বাবধানে চলত হাসপাতালটি। স্বাধীনতার আগেও এখানে ডাক্তার থাকতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন নূরুল ইসলাম নামের একজন ডাক্তার। বাড়ি ছিল কুমিল্লায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁশতলাতে সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টারে হাসপাতাল হলে এই নূরুল ইসলাম ডাক্তার হিসাবে সেবা দিয়ে গেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোন ডাক্তারই এখানে স্থায়ীভাবে থাকেন নি। কম্পাউন্ডাররাই ডাক্তার হিসাবে কাজ করছেন। প্রতিদিন অসংখ্য রোগিকে তাদের সামাল দিতে হয়। ডাক্তার না থাকায় ইউনিয়নবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
লক্ষীপুর ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপ সহকারী মেডিকেল অফিসার মো. মনিরুল ইসলাম বললেন, ঝাড়– দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজই আমাকে একাই করতে হয়। এখানে মেডিকেল অফিসার, ফার্মাসিস্ট ও অফিস সহায়কের পদ থাকলেও সবই শূন্য। ২০১৬’এর শেষের দিকে এই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদান করি, দুই মাস ডা. রাশেদুল হাসানকে পেয়েছিলাম। তিনি চলে যাবার পর আর কেউ এখানে আসেননি। গড়ে প্রতিদিন ৪০-৪৫ জন রোগী আসে। এই ইউনিয়নের ছাড়াও আশপাশের লক্ষীপুর, ভোগলা, সুরমা ও রঙ্গাচরের একাংশের মানুষ এখানে চিকিৎসার জন্য আসে। ওষুধ যা বরাদ্দ পাওয়া যায়, তা দিয়ে তিন মাস চলে না, শেষের দিকে রোগীকে দেওয়া সম্ভব হয় না। আমি অফিস সময়ে রোগী দেখে ভিজিট নেই এই অভিযোগ সত্য নয়। অফিস সময়ে বাইরে গিয়ে রোগী দেখার জন্য স্থানীয়রা বললেও আমি যাই না। অফিসের কাজ ছাড়া অফিস সময়ে কর্মস্থল ছাড়ি না। ছুটিতে গেলে ভিজিটর নূর জাহান বেগম উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বসেন।’ তিনি জানালেন, এই হাসপাতালের টিনশেড ঘরটি ব্যবহার না করায় এখন অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
লক্ষীপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম জানালেন, একজন উপসহকারী মেডিকেল অফিসার দিয়ে কোনভাবেই ৩০ হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি লক্ষীপুরে ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল করার দাবি জানালেন।
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাস বলেন,‘সুনামগঞ্জে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ২২ টি এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ৫৪ টি। এরমধ্যে তাহিরপুরের শ্রীপুরে ডা. মৃত্যুঞ্জয় কুমার এবং উত্তর শ্রীপুরে ডা. সাব্বির চৌধুরী এবং বিশ্বম্ভরপুরের ধনপুরে ডা. শারমিন হোসেন এবং গোবিন্দনগরে ডা. সৈয়দ হাসিনুল হক পদায়িত। ডা. সৈয়দ হাসিনুল হক বিনা অনুমতিতে প্রায় আড়াই বছর হয় আয়ারল্যাণ্ডে আছেন। এই বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ’