শোন হে , হিংসুটে সিলেট বিদ্বেষী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৭, ৫:৪৭ অপরাহ্ণ
সারওয়ার চৌধুরী:
সিলেটের প্রবাসী সহ সিলেটীদের নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে । সাধারণ মানুষ ছাড়াও অনেক শিক্ষিত , সমাজে যারা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবি হিসেবে জাহির করতে ভালবাসেন , তারাও কারণে অকারণে সিলেটের প্রতি, সিলেটবাসীর প্রতি হিংসাত্বক মনোভাব পোষণ করেন । তাদের ধারণা বর্তমানে দেশে বিদেশে সিলেটীদের যে সুদৃঢ় অবস্হান ….সামাজিক , রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক উত্তান …. সেগুলো যেন ভাগ্য গুণে এসেছে । তাদের জানা উচিত আজকের সিলেটীদের উত্তানের পেছনের অগণিত করুণ ত্যাগ তিতিক্ষার কাহিনী , ইতিহাস । বিলেতে সিলেটীদের পদচারণা শুরুর ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে , ১৮৫৬ সালের দিকে সিলেটে বাণিজ্যিক ভাবে ইংরেজদের মাধ্যমে চায়ের চাষ শুরু হয় । তখন চা রফতানীর জন্যে ইন্জিন চালিত জাহাজ সিলেটে যাওয়া আরম্ভ করে । এ সমস্ত জাহাজে বয়লারের কাজে , ইন্জিন রুম , ডেক ইত্যাদির জন্যে জাহাজ কোম্পানি গুলো খালাসী এবং লস্কর হিসেবে চাকুরী দিত সিলেটীদের । জাহাজে কাজ করা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর । ভয়াবহ গরমের মধ্যে বয়লারে কয়লা দেওয়ার কাজ অনেক কম পারিশ্রমিকের বিনিময় সিলেটীরা করতেন যে গুলিতে শেতাঙ্গদের নিয়োজিত করলে অনেক বেশী পারিশ্রমিক দিতে হত ।এ খালাসী এবং লস্কররা প্রথমে আসতেন কলকাতায় । তাদের অনেকেই যেতেন বিলেত পর্যন্ত , তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । পরবর্তীতে তাদের কাজের পরিধি তৈরী করেন রেস্টুরেন্টে কাজ করার মধ্যে দিয়ে ।
ভৌগলিক দিক থেকেও সিলেটের অবস্হান অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং লোভনীয় । যার কারণে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির সময়ে উভয় দেশেরই লোলুপ দৃষ্টি ছিল সিলেটের উপর । কিন্তু আমরা সিলেটীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি , আমরা বাঙালী , বাংলাদেশী । তাই সকল বিভক্তিতেই সব লোভ লালসা আর বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রস্তাবনাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশী বিশ্বাসে আমরা সিলেটীরা সব সময় বাংলাদেশের সাথেই অবস্হান নিয়েছি । সিলেটের পরিস্হিতিটা এরকম যে , সমস্ত দেশটাকে একদিকে রেখে নিজেরা শক্তিশালী ভাবেই মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াতে পারবে …. কিন্তু সিলেট ছাড়া সমস্ত দেশটাই আকর্ষণহীন , সম্পদহীন , দুর্ভিক্ষ পীড়িত , দূর্বল । তাই সিলেট আর সিলেটীদের অবদান কিংবা অবস্হানকে উপেক্ষা করা হবে নির্বুদ্ধিতা এবং অজ্ঞতার পরিচায়ক ।
সিলেটীরা কখনই স্বার্থপর নয় , প্রবাসী প্রত্যেক সিলেটীই নিজের ব্যক্তি স্বার্থের চাইতে পরিবার , আত্মীয় – স্বজন , সর্বোপরি দেশের স্বার্থটাকেই এগিয়ে রাখেন । নিজে স্বাবলম্ভী হওয়ার পাশাপাশি দেশে অবস্হানরত অন্যান্য স্বজনরাও কিভাবে সুখী হতে পারে , নিজেদের আর্থিক অবস্হানের উন্নতি করতে পারে …. সেই সব বিষয় গুলিতে সব সময় সক্রিয় থাকেন । বিলেত কিংবা আমেরিকা , সিলেটী ফার্স্ট জেনারেশন চাইলেই খুব সহজেই নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে মেতে উঠতে পারতেন , অনাবিল সুখ সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে দিতে পারতেন …. কিন্তু তারা সেগুলো না করে নিজেদেরকে উজাড় করে দিয়েছেন দশের , দেশের তথা পরবর্তী প্রজন্মের তরে । ফলশ্রুতিতে আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিলেত কিংবা আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে সিলেটীদের সফল আর গর্বিত পদ চারণা । আজকে বৃটেনের পার্লামেন্টে সিলেটী , গভর্ণর হিসেবে মনোনীত হয়েছেন সিলেটী , শীর্ষ ব্যবসায়ী কিংবা ধনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন সিলেটী । আজকে যারা সিলেটীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন তাদের হয়তো চৌদ্দ জনমেও সম্ভবপর হবে না ঐ পর্যায়গুলোতে পৌঁছা , তাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না ঐ সমস্ত সিলেটীদের পাশাপাশি কিংবা সামনা সামনি দাঁড়াবার ।
প্রথম প্রজন্মের নিঃস্বার্থ ত্যাগের ফসল ভোগ করছে বর্তমান প্রজন্ম । বর্তমান প্রজন্মের আর প্রয়োজন পড়েনা নিম্মমানের চাকুরীর । তারা নিজেরাই এখন চাকুরী সৃষ্টিকারী অথবা উচ্চ পর্যায়ের চাকুরী জীবি । বৃটেন, আমেরিকা…..এসব দেশগুলোতে ব্যক্তিগত মনোন্নয়ের জন্যে , শিক্ষা দীক্ষায় নিজেকে বিকশিত করার জন্যে বয়স , আর্থিক অবস্হা এগুলো কোন সমস্যা নয় …. সুযোগের ছড়াছড়ি সর্ব ক্ষেত্রে । কিন্তু সিলেটের প্রথম প্রজন্মের ঐ সমস্ত নিঃস্বার্থ ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যক্তি উন্নয়নের চিন্তাকে ছুড়ে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে কিভাবে উন্নত করা যায় , স্বদেশের উন্নয়নে কিভাবে অবদান রাখা যায় , এই বিষয়গুলিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন । তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে , নিজেরা ইচ্ছে করলে হয়তো ব্যক্তি উন্নয়ন করতে পারবেন , নিজেদের শিক্ষিত প্রশিক্ষিত করতে পারবেন, মানসম্মত চাকুরী করতে পারবেন …. কিন্তু তারপরে জীবনদশায় যে সময়টুকু পাবেন সেটা হয়তো যথেষ্ট হবেনা পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া কিংবা স্বদেশে অবস্হানরত নিজেদের আত্মীয় -স্বজনকে পর্যাপ্ত সহযোগীতা করা । তাই তো দেখা যায় যতই তারা নিম্নস্তরের কাজ করেন না কেন …. তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কখনও নিজেদের মতো করেন নি , তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে বৃটেনের মূলধারার সমকক্ষ করে তুলছেন । আবার এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভুলে যাননি নিজেদের ধর্ম ,কৃষ্টি -কালচার । তাই তো পরবর্তী প্রজন্মকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা দিয়েছেন স্বদেশীয় কৃষ্টি , সংস্কৃতি । সুতরাং সিলেট অথবা সিলেটী সম্পর্কে যারা বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করেন , তাদের উপলব্ধি করা উচিত সিলেটীদের এই সমস্ত আত্বত্যাগ গুলি, উদার এবং উন্নত মন মানসিকতার পরিচয়গুলি । জানি সেগুলো হৃদয়াঙ্গম করা হিংসুকদের পক্ষে সম্ভবপর নয় । তারা ঐ সমস্ত প্রজন্ম টজন্মের ধার ধারেনা । তারা ব্যস্ত ব্যক্তিগত চিন্তায় , কিভাবে নিজে উন্নতভাবে বেচে থাকবেন , সেটাই তাদের কাছে মুখ্য । নিজেদের সাথে সাথে যে পরবর্তী প্রজন্ম , আত্মীয় – স্বজন, সর্বপরি স্বদেশকে উন্নত জীবন ধারায় নিয়ে আসার মত ধ্যান ধারণা , মহৎ চিন্তা শক্তির বড়ই অভাব ঐ সমস্ত স্বার্থপর হিংসুকদের । তাই বলতে ইচ্ছে হয় , সিলেটী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রকাশ করার আগে তাদের সাথে মিশুন …. হিংসা নয় বরং সিলেটীদের কাছ থেকে শিক্ষা নেন কিভাবে মহৎ প্রাণ হওয়া যায় , কিভাবে স্বার্থহীন হয়ে নিজের সাথে সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম , স্বজন কিংবা স্বদেশের উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করা যায় । সেটাই হবে স্বদেশ তথা সবার মঙ্গল ।
আমরা সিলেটীদের জেনারেল আইসেনহাওয়ার নীতি অবলম্বনে করা উচিত , অর্থাত্ ” আমরা যাদের পছন্দ করিনা অথবা যারা আমাদের পছন্দ করেনা , তাদের ভাবনায় যেন এক মিনিটও সময় নষ্ট না করি । ” আমাদের সিলেটীদেরকে বুঝতে হবে যে সিলেটীদের সম্পর্কে অশালীন , অসুন্দর আর আপত্তিকর এ সমস্ত মন্তব্যের মাধ্যমে অনেকেই আলোচনায় আসতে চায় , আলোচিত হতে চায় …. আমাদের উচিত হবেনা তাদের ফাঁদে পা দিয়ে এ সমস্ত নিম্ন রুচি ও মানের লোকদের মন্তব্যের জবাব দিয়ে, আলোচনা সমালোচনা করে তাদের উদ্দেশ্যকে সফল করা । বাংলাদেশের সর্বস্তরের , সর্ব এলাকার জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবি তথা সকল বিবেক বিবেচনা সম্পন্ন নাগরিকই জানেন . উপলব্ধি করেন,…. বাংলাদেশের প্রতি , মাতৃভূমির প্রতি সিলেট এবং সিলেটীদের অবদান ।
তাই হিংসুটে সিলেট বিদ্বেষীদের বিখ্যাত দার্শনিক এপিকটেটাসের ভাষায় বলব ” তোমাদের দেহে থেকে টিউমার বা পুঁজ বের করে দেওয়ার চেয়েও বদ চিন্তা তাড়ানো অনেক বেশী প্রয়োজনীয় । ” তুমি বা তোমরা যদি সিলেট বিদ্বেষী হও তাতে আমরা সিলেটীদের কিচ্ছু যায় আসেনা … তোমার বিদ্বেষী মনোভাব তোমার নিজের অন্তরাত্বাকে , চিন্তাশক্তিকেই কলুষিত করবে । আমরা সিলেটীরা নিজেদের যোগ্যতা দক্ষতা সততা আন্তরিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে প্রবাসে আমাদের যে একটা মজবুত সুদৃঢ় অবস্হান তৈরী করেছি সেটাকে হিংসার মাধ্যমে অতিক্রম করতে গিয়ে নিজেই পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাবে ।
লেখকঃ সারওয়ার চৌধুরী,
আমেরিকা প্রবাসী।
(সুরমানিউজ এর পাঠককলামে প্রকাশিত সব লেখা পাঠক কিংবা লেখকের নিজস্ব মতামত। এই সংক্রান্ত কোনো ধরনের দায় সুরমানিউজ বহন করবে না। সুরমানিউজ এর কোনো লেখা কেউ বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করতে পারবেন না।)