কুরবানী মুমিনদের অগ্নি পরীক্ষা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০২৩, ১০:১৯ অপরাহ্ণ
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান:
আরবি ‘কোরবাতুন’ শব্দ থেকে কোরবানির উৎপত্তি। এর অর্থ নৈকট্য অর্জন করা। এর ভাবার্থ হচ্ছে- ত্যাগ স্বীকার করা, বিসর্জন দেয়া, উৎসর্গ করা। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও তাঁর ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নিয়মে পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীকে কোরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেছেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়–ন ও কোরবানি করুন।’ (সূরা কাওসার : ২)। এ আয়াতে নামাজ আদায় করতে এবং কোরবানির পশু জবাই করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন কোরবানি সম্পর্কে অত্যন্ত যতœবান ছিলেন।
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি পালন করা ওয়াজিব। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন না করে, তার ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, ‘যার কোরবানি করার সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম, আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব)। এটি বান্দা তাঁর প্রভুর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। প্রথম মানুষ ও আদিপিতা হজরত আদম (আ.) এর পুত্র হাবিল-কাবিল থেকে শুরু করে মুসলিম মিল্লাতের জনক হজরত ইবরাহিম (আ.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর উম্মতই বিভিন্ন পদ্ধতিতে কোরবানি করেছেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করার পূর্ণ প্রচেষ্টায় আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে এর স্থলে পশু কোরবানির নির্দেশ দিয়েছেন। তখন থেকেই পশু কোরবানির বর্তমান নিয়মের সূচনা, যা অপরিবর্তিতভাবে আমাদের জন্যও বিধানসম্মত করা হয়েছে। এ হিসেবে কোরবানি হজরত ইবরাহিম (আ.) এর মহান সুন্নত। কোরবানি করতে গিয়ে সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি না জানার কারণে আমরা অনেকেই বিভিন্নি ভুলত্রুটি করে থাকি। এমনকি কোরবানির যে মূল উদ্দেশ্য, নিয়ত, পরিশুদ্ধ করা, তাও অনেকের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে চক্ষুলজ্জা, লোকদেখানো ইত্যাদি প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তয়াালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত কিংবা রক্ত পৌঁছায় না; বরং তাঁর কাছে শুধু তোমাদের তাকওয়া পৌঁছায়।’ (সূরা হজ : ৩৭)।
তাই আমাদের বিশুদ্ধ নিয়তে কোরবানি করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান কালে প্রতি বছর কোরবানি করেছেন এবং সাহাবিদের কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি পালনে অনেক ফজিলত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে কোরবানি প্রতিপালন করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিস শরিফেও রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানি পালনের অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবিরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এ কোরবানিটা কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) জবাব দিলেন, এটি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত বা আদর্শ। এরপর তারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের জন্য কী উপকার বা সওয়াব রয়েছে? তিনি বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকি রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম আবার জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ভেড়া, দুম্বার পশমের ব্যাপারে কী কথা? তিনি বললেন, এর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি পাওয়া যাবে’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত শরিফ)।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষের আমলগুলো থেকে কোনো আমলই আল্লাহর কাছে কোরবানির দিন কোরবানি থেকে অধিক পছন্দনীয় নয়। অবশ্যই কেয়ামতের দিন কোরবানির প্রাণী শিং, লোম ও ক্ষুর নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। যে কোরবানি শুধু আল্লাহর জন্য করা হয়, নিশ্চয়ই সেই কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা ভক্তি ও আন্তরিকতার সঙ্গে কোরবানি করো’ (তিরমিজি)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত ফাতেমা (রা.) কে বললেন, ফাতেমা! এসো তোমার কোরবানির পশুর কাছে দাঁড়িয়ে থাক। কারণ কোরবানির পশুর রক্তটা মাটিতে পড়বে, তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তোমার আগের গোনাহগুলো মাফ করে দেবেন। ফাতেমা (রা.) বলেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায় আতের (নবী পরিবারের) জন্য নির্দিষ্ট, না সকল উম্মতের জন্য? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমাদের আহলে বায়আতের জন্যও এবং সকল উম্মতের জন্যও’ (জামেউল ফাওয়ায়েদ)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর জীবনযাপন করেছেন, সেখানে প্রতি বছরই তিনি কোরবানি করেছেন’ (তিরমিজি)।
আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে এবং নৈকট্য লাভই মানুষের একমাত্র জীবনোদ্দেশ্য বা মাকসাদ হওয়া উচিত।
আল্লাহ তায়ালা সদা-সর্বদা বান্দার কল্যাণ চান, তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের নানাবিধ উপায় খুলে রেখেছেন। বান্দাহ একটু মনোযোগী হলেই সে সুযোগ লাভ করতে পারে। কুরবা অর্থ নৈকট্য। পশু কুরবানির মাধ্যমে বান্দা সে লক্ষ্য হাসিল করতে পারে। আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি একটি কুরবানির নিয়ত ঠিক করে দিয়েছি। যাতে উম্মতের লোকেরা পশুদের ওপর আল্লাহর নাম লয় (আল্লাহ নাম নিয়ে পশু জবেহ করে)। যেগুলো তিনি তাদের দিয়েছেন তা থেকে।
পশু কুরবানির উদ্ভব হয়েছে এক বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যদিয়ে। আল্লাহর অতি প্রিয়ভাজন, নৈকট্যপ্রাপ্ত মহান ব্যক্তি হজরত ইব্রাহীম (আ.) যাঁকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর খলিল বা বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন। আল্লাহ প্রেমে তাঁর অনন্য ত্যাগের গৌরবময় নিদর্শনকে কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের স্মৃতির ফলকে অঙ্কিত করে রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা পশু কুরবানির এ বিধান জারি করেন।
আল্লাহ বলেন, (ইব্রাহীম দুআ করল) হে আমার রব! আমাকে একজন নেক সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে একজন ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।
সে যখন তাঁর (পিতার) সাথে দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হলো তখন সে ছেলেকে বলল, হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি (যেন) আমি তোমাকে জাবেহ করছি (বলো এ ব্যাপারে) তোমার অভিমত কি? সে বলল, আব্বাজান, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।
অতঃপর যখন তারা দু’জনই (পিতাপুত্র) আত্মসমর্পণ করল এবং সে (পিতা) তাকে (জবাই করার উদ্দেশ্যে) কাত করে শুইয়ে দিল।
তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ, (মূলত) আমি এভাবেই সৎ কর্মশীল মানুষদের পুরস্কারে ভূষিত করি।
এটা ছিল (তাদের উভয়ের জন্য) পরীক্ষা মাত্র। আমি তার ছেলের পরিবর্তে একটা বড় ধরনের (জন্তু) দান করলাম (কুরবানির জন্য)। পরবর্তী মানুষদের স্মরণে আমি এ বিধান রেখে দিলাম।
শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহীমের ওপরে।
আল্লাহর প্রেমে উদ্বেলিত হয়ে পিতা যেমনি নিজের প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন পুত্রও তেমনি আল্লাহর নির্দেশ পালনে নির্দ্বিধায় পিতার ছুরির নিচে নিজের গর্দান পেতে দিতে সামান্যতম কুণ্ঠিত হননি। একেই বলে ‘বাপ কা বেটা’! আসলে এই পুত্রই তো পরবর্তী নবী হজরত ইসমাইল (আ.)।
ইতিহাস এবং তাফসীর থেকে জানা যায়, শয়তান তিনবার হজরত ইব্রাহীমকে (আ.) প্রতারিত করার চেষ্টা করে আর ইব্রাহীম (আ.) প্রত্যেকবারই সাতটি করে কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে শয়তানকে বিতাড়িত করেন। আজ পর্যন্ত সেই প্রশংসনীয় মহৎ কাজের স্মৃতি মিনায় শয়তানকে তিনবার কংকর নিক্ষেপ করার মাধ্যমে উদযাপিত হয়ে আসছে। অবশেষে পিতাপুত্র উভয়েই যখন এই অভাবনীয় অভিনব ইবাদত করার উদ্দেশ্যে কুরবানি করারস্থলে পৌঁছে গেলেন তখন ইসমাইল (আ.) বললেন, আব্বাজান! আপনি আমার হাত-পা বেঁধে নিন, অস্ত্রের আঘাতে বেদনার তীব্রতায় হয়তো আমি ধৈর্যহারা হয়ে পড়তে পারি। আপনিও চু বেঁধে নিন। কেননা আমার ওপর নজর পড়ে আপনার দিলে পুত্র-বাৎসল্য জাগ্রত হলে আপনার হাত শিথিল হয়ে পড়তে পারে। না, না, আমার হাত-পা মুক্ত থাক। কালকিয়ামতে আল্লাহ যদি বলেন যে, তোমার হাত-পা বাঁধা না থাকলে তুমি স্বেচ্ছায় কুরবানি হতে রাজি থাকতে না। তখন আমি কি জবাব দেব? আপনি আমার রক্তমাখা জামা-কাপড়গুলো আমার আম্মাজানের নিকট পৌঁছে দিবেন। এগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি পুত্রশোকের তীব্রদাহ কিছুটা হয়তো প্রশমিত করতে পারবেন। প্রিয় পাঠকগণ! পুত্রের এমন হৃদয়বিদারক উক্তি শুনে এমন কোনো পিতা আক্ষাছেন কি পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে পারে?
পিতাপুত্রের এই অভাবনীয় ত্যাগের স্মৃতিকে পশু কুরবানির মধ্যদিয়ে জাগ্রত রেখে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরও ত্যাগের মহিমা অর্জন ও পুরস্কার লাভে ধন্য হবার সুযোগ করে রেখেছেন। আমরা যদি সন্তান কুরবানির জন্য আদিষ্ট হতাম তাহলে ঈমানের পরীক্ষায় পিতাপুত্র কেউই টিকে থাকতে পারতাম বলে মনে হয় না।
সূরাতুল হজে আল্লাহ তায়ালা পশু কুরবানির আরো কয়েকটি উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন, “তাদের গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, রক্তও না। কিন্তু পৌঁছে তাকওয়া। তিনি এগুলোকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার।” (হজ : ২৮)
জাহেলী যুগে কুরবানির গোশত দেবতার বেদীমূলে অর্ঘ্য দিত এবং বেদীর চারপাশে রক্ত মেখে দিতো। এ আয়াতে তার অপনোদন করা হয়েছে। পশুদের মালিকানা যে মানুষের নয় আল্লাহর, মানুষকে উপকারের জন্য দেয়া হয়েছে। এ বুঝ সৃষ্টি এবং উপকারের শুকুরগুজারী হিসেবে পশু কুরবানির সময় উচ্চ স্বরে আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে তাঁর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর তরফ থেকেই কুরবানির দিন তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এবং কিভাবে কুরবানির গোশত বিলি বণ্টন করা হবে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তাদের যে সকল পশু দান করেছেন, কয়েকটি নির্ধারিত দিনে (ঈদের দিন ও ঈদের পরের দু’দিন) সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয়। অতঃপর কুরবানির সে গোশত থেকে নিজেরা খাবে, দুঃস্থ এবং অভাবগ্রস্তদেরও তার কিছু অংশ দিয়ে আহার করাবে। (হজ : ২৮)
নিজেরা খাবে বলতে এর মধ্যে আত্মীয়-স্বজনও এসে যায়। তাই উলামায়ে কিরামদের সম্মিলিত ইস্তিহাদী রায়ে কুরবানির গোশতকে তিনভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। তবে কুরবানিতে শরিকদের ভাগ যেমন উনিশ-বিশ করা যায় না। ঐ তিনভাগের ব্যাপারে তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই।
হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রতিবছর প্রত্যেক পরিবারের তরফ থেকে একটি কুরবানি করা কর্তব্য। (আবু দাউদ, তিরমিজী)
কুরবানির মর্যাদা ও মাহাত্ম্য মা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে নবী করীম (সা.) বলেছেন, কুরবানির দিন কোনো ব্যক্তি রক্ত ঝরানোর তুলনায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় পছন্দনীয় অন্য কোনো কাজ করতে পারে না। জবাই করা জন্তু কিয়ামতের দিন উহার শিং পশম ও খুর নিয়ে উপস্থিত হবে কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নিকট সন্তুষ্টির মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা মনের সুখ ও সন্তোষ নিবন্ধ কর। (তিরমিজী, ইবনে মাজাহ)
হাদীসে এসেছে, পশুর গায়ে যত লোম রয়েছে কুরবানিদাতা তার সমপরিমাণ নেকী লাভ করে থাকে। (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)
অন্য একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, কুরবানির পশু কুরবানি দাতার জন্য যেমনর সওয়াব লাভের উপায় হবে তেমনি উহা পুলছিরাত পার হবার জন্য বাহন হতে পারে। (ইবনে মাজাহ)
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি দেয় না রাসূল (সা.) তার প্রতি ভীষণ উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি দেয় না সে যেন আমার নামাজ পড়ার স্থানের নিকটেও না আসে।
হজরত আবু হানিফার (রা.) মতে, কুরবানি করা সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। অন্য ইমামগণ বলেছেন, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তা যাই হোক, সামর্থ্যবান ব্যক্তির অবশ্যই কুরবানি করা দরকার। কেননা, পশুর গায়ের পশম যেমন গুণে শেষ করা যায় না, কুরবানিদাতার সওয়াবও তেমনি গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। এমন সুযোগ মোটেই ছাড়া উচিত নয়। পরিণত বয়সের নিখুঁত হৃষ্টপুষ্ট পশুই আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি করা উচিত। ছাগল, দুম্বা, ভেড়া একজন একটি, গরু-মহিষ সাতজনে এবং উট দশজন পর্যন্ত কুরবানি করতে পারে। কুরবানিতে শরিকদের প্রত্যেকের নিয়ত এবং পয়সা সহীহ হতে হবে। একজনের নিয়ত এবং পয়সা যদি সহীহ না হয় তবে গোটা কুরবানিই সহীহ হবে না।
অনেকের নিয়ত থাকে কুরবানি না দিলে সমাজে ইজ্জত থাকে না। কুরবানি না দিলে ছেলেমেয়েরা মনমরা হয়ে পড়বে। আবার রাজনৈতিক নেতারা বিশটা, ত্রিশটা কুরবানি দেয় এলাকাবাসীর খুশির লক্ষ্যে, যাতে তারা নির্বাচনের সময় ভোট দেয়। কুরবানি করতে হবে শুধু আল্লাহর রাজি-খুশির উদ্দেশ্যে। নইলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। তাছাড়া সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই, জ্বিনা-ব্যভিচার, দ্রব্যে ভেজাল, সংমিশ্রণ করে ওজনে কম দিয়ে যে আয় করা হয় তা দিয়ে যত বড় গরুই কুরবানি করা হোক না কেন তা আল্লাহ কবুল করেন না। পশমে পশমে সওয়াব তো দূরের কথা পশমে পশমে গুনাহ কুড়ানো ছাড়া আর কোনো বিনিময় তাতে পাওয়া যাবে না।
পরিবার প্রধানের ওপর কুরবানি ওয়াজিব। নিজের ওয়াজিব আদায় করার পর জীবিত-মৃত যেকোনো ব্যক্তির নামে কুরবানি করা যাবে। নিজের নামে না করে অন্যের নামে কুরবানি করলে ওয়াজিব আদায় হবে না। পরিবারের কোনো সদস্যের যদি নিজস্ব আয় থাকে এবং কুরবানি দেবার সামর্থ্য থাকে তাকেও কুরবানি করতে হবে। পশু জবেহকারী ও গোশত বানানো ব্যক্তিদের পারিশ্রমিক বাবদ টাকা দিতে হবে, গোশত দিয়ে পারিশ্রমিক দেয়া ঠিক নয়। তবে পারিশ্রমিক দেয়ার পর নিজেদের ভাগ থেকে তাদের গোশত দেয়া উচিত।
কুরবানির চামড়া বা চামড়ার পয়সায় গরিবদের হক রয়েছে। তবে মানসম্মত কোনো ইসলামী সংগঠনকে চামড়া বা টাকা দিলে তারা সংগঠনের মাধ্যমে অনেক বড় কাজ করতে পারেন। যা দু’একজনের কুরবানির চামড়ার পয়সা দিয়ে করা সম্ভব নয়।
পরিশেষে কুরবানির একটা সামাজিক মূল্যায়ন রয়েছে। তাহলো কুরবানির গোশত বিলি-বণ্টনের মাধ্যমে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। পরস্পর সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। তাছাড়া গরিব অসহায় মানুষ যারা সারা বছরে এক টুকরা গোশতের স্বাদ চাখতে পারে না। বছরে একবার অন্ততঃ তাদের গোশত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। চারশো টাকা কেজি গরু এবং সাড়ে পাঁচশো টাকা খাসির গোশত কিনে খাওয়া মধ্যবিত্তদেরই তেমন একটা সুযোগ হয়ে উঠে না, গরিব অসহায় মানুষেরা কিনে খাবে কি করে?
আসুন আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য রয়েছে আমরা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিয়মিত ওয়াজিব আমলটি যথাযথভাবে পালন করি এবং এর পরিপূর্ণ সওয়াব অর্জন করি।