এম সাইফুর রহমান : এক পরিশুদ্ধ রাজনীতিবিদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮:১২ অপরাহ্ণ
দেশের দীর্ঘতম সময়ের ও সফলতম অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মৌলভীবাজারের বাহার মর্দন থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সাইফুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ১২ বার জাতীয় বাজেট পেশ করে এ উপমহাদেশ তথা গোটা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত দাঁড় করিয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়গুলো ছিল তাঁর নখদর্পণে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড় করানোর ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য।
বিদেশি সাহায্য ছাড়াও যে দেশ চলতে পারে দেশের উন্নতি হতে পারে, সেই ধারণাও দিয়েছিলেন সাইফুর রহমান। বিএনপির সাফল্যের সাথে সাইফুর রহমান নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের অর্থনীতিতে তিনি সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার অন্যতম রূপকার তিনি। দেশপ্রেমিক বিশাল হৃদয়ের এই কৃতী মানুষটি আমাদের ছেড়ে এ পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তাঁর কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে।
সাইফুর রহমান যে ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন বৃহত্তর সিলেট তথা দেশের উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, তা দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষই স্বীকার করে। দেশের জন্য, দেশবাসীর উন্নয়নের জন্য এমন এক রাজনৈতিক নেতার বর্তমান সময়ে খুবই প্রয়োজন ছিল। তাঁর মতো উদারপন্থী বাস্তবতায় বিশ্বাসী সংস্কারবাদী এমন নেতা দেশে প্রায় দুর্লভ। তিনি ছিলেন একজন কল্যাণমুখী রাজনীতিবিদ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন আধুনিক, বৈষম্যহীন অর্থনীতির বাংলাদেশ।
অতুলনীয় মেধার অধিকারী ছিলেন তিনি। বিশ্ব ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সাইফুর রহমান জনকল্যাণে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে সাইফুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি প্রথমে মৌলভীবাজার পরে সিলেট এম.সি কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে চাটার্ড একাউটেন্টে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংস্পর্শে এসে বিএনপিতে যোগদান করে হয়ে যান যথার্থ অর্থেই একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেতা।
তিনি কৃষি ও কৃষকের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। কৃষকরা যাতে তাদের জীবনমান উন্নত করতে পারে, তা নিয়ে তিনি ভাবতেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, কৃষিই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বস্তিবাসী মানুষের মানবাধিকারের কথাও তিনি বলতেন। যা তিনি ভাবতেন তা তিনি সভা সমিতিতেও বলতেন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। এমন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ তিনি ছিলেন যার গুণাগুণ বলে শেষ করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অনেক দিনই তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। তিনি সব সময়ই পরিচিত মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি প্রবাসীদের খুবই ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন এবং প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ করতে পরামর্শ দিতেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। আমি তখন লন্ডনে। হঠাৎ শুনলাম, সাইফুর রহমান লন্ডনে আসবেন। লন্ডনের হাইড পার্কের একটি বিলাস বহুল হোটেলে উঠবেন। লন্ডনে বসবাসরত কমিউনিটি নেতা ও আমার এক আত্মীয়ের সাথে হোটেল পার্ক লেনে গেলাম। নিজের চোখে দেখলাম, দীর্ঘ সময় বিমান ভ্রমণ করার পরও তিনি ক্লান্তি বোধ না করে যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দিলেন। এত বড় মাপের একজন নেতা কোনো প্রকার বিশ্রাম ছাড়াই সাক্ষাৎ প্রার্থী অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বললেন, কুশল বিনিময় করলেন এবং সকলকে তিনি দেশে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখে। তিনি প্রবাসীদের বললেন, বিনিয়োগ হলো দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি দেশের পর্যটন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করার জন্য প্রবাসীদের পরামর্শ দিলেন। তিনি ব্যাংকে অলস টাকা ফেলে না রাখারও পরামর্শ দিলেন।
মানুষের জীবনে জন্ম ও মৃত্যু শ্বাশত। এমন কেউ নেই যাকে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। কুরআনে বলা হয়েছে, কুল্লু নাফছিন জায়িকাতুল মউত অর্থাৎ প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। মানুষ যেমন নিজের ইচ্ছায় এ পৃথিবীতে আসেনি, তেমনি নিজের ইচ্ছায় এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারবে না। তাকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলার অমোঘ নিয়তির নির্দেশ মানতে হবে। কিন্তু মানুষ ইচ্ছে করলে মৃত্যুকে জয় করতে পারে। মানুষ চাইলে বেঁচে থাকতে পারে শত শত বছর। আর শত শত বছর বেঁচে থাকতে হলে এমন কিছু কর্ম করে পৃথিবীতে রেখে যেতে হবে, যা মানুষ স্মরণ করবে। এমনই স্মরণীয় একজন মানুষ ছিলেন সাইফুর রহমান। তাঁর কর্মময় জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যোগাবে নিঃসন্দেহে। মানুষেরা একটা ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে। এরপর চলে যায়। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন অর্থবহ হয় তখনই, যখন তার কর্মে সন্তুষ্ট হয় স্বজন, প্রতিষ্ঠান ও দেশবাসী। মূলত মানুষ হচ্ছে তার কর্মেরই যোগফল। মানুষ তার কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকে চিরকাল। সাইফুর রহমান তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, আইনজীবী ও সাংবাদিক।