সিলেটের শাহী ঈদগাহে এবার ‘ক্ষমতাসীনবিহীন’ ঈদ জামাত
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০২৫, ৯:৩৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহ প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে এই ঈদগাহ নির্মাণ হয়। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার প্রধান ঈদের জামাত তখন থেকে প্রচলিত। লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে ঈদ জামাতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা থাকতেন নেতৃত্বে। সাড়ম্বরে অংশ নিতেন সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ সব দলের নেতৃস্থানীয়রা। তবে এবার হচ্ছে ব্যতিক্রম। সেই মোগলশাহি স্মরণে রেখে এ অবস্থাকে বলা হচ্ছে ‘ক্ষমতাসীনবিহীন’ ঈদ জামাত।
৫ আগস্ট সরকারের পতন-পরবর্তী বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য নেতারা এলাকাছাড়া। সাবেক মন্ত্রী-এমপি কেউ দেশে নেই। এ অবস্থায় শাহী ঈদগাহের মোতওয়াল্লির দায়িত্ব নিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) দুই মেয়াদের সাবেক মেয়র ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী।
রবিবার (৩০ মার্চ) বেলা আড়াইটায় শাহী ঈদগাহ এলাকা পরিদর্শন করে আরিফুল হক চৌধুরী সেখানকার সর্বশেষ প্রস্তুতি সম্পন্নের বিষয়টি আইনৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিত করেন।
এর আগে ঈদগাহ পরিদর্শন করেন সিসিকের প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার মো. রেজাউল করিমসহ পদস্থ কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
সোমবার ঈদের দিন সকাল সাড়ে ৮টায় ঈদের জামাত হবে। পরিবর্তিত অবস্থায় মোতওয়াল্লির দায়িত্ব নিতে হয়েছে জানিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুপ্রাচীন ও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বছরে দুটি ঈদে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন মুসল্লিরা। এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মজলুমদের জন্য বিশেষ মোনাজাতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহিদ ও আহতদের প্রসঙ্গও থাকবে।’
স্থানীয় ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সিলেটের ফৌজদার ফরহাদ খাঁর তত্ত্বাবধানে ঈদগাহটি নির্মাণ হয়। সিলেট নগরীর উত্তর-পূর্বকোনের টিলাভূমিতে মোগল স্থাপত্যশৈলীর ঈদগাহটি স্থাপত্যকর্ম দৃষ্টিনন্দন। প্রাচীন স্থাপত্যের সঙ্গে হালআমলের উন্নয়ন ও সংস্কারে নির্মিত হয়েছে সুউচ্চ মিনার ও সুপরিসরের ময়দান। তবে মূল স্থাপত্য নকশা আছে সেই মোগল আমলের আদলেই। ফলে ঈদগাহটি মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবেও সমাদৃত।
সমতলের চেয়ে উঁচু টিলাভূমিতে ঐতিহ্যবাহী এই ঈদগাহের অবস্থান। ঈদগাহ ময়দানের মধ্যখানে কারুকার্যখচিত ২২টি দীর্ঘকায় সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে উঠলে দেখা মিলে মূল ঈদগাহ ও মিম্বর। ১৫টি গম্বুজ, সুউচ্চ একটি মিনার অনন্য রূপ দিয়েছে। টিলা থেকে সমতলে নামার মতো করে মূল অংশের নিচে রয়েছে সুবিশাল ঈদগাহ ময়দান। যেখানে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন দেড় লক্ষাধিক মুসল্লি। পুরো ঈদগাহ ময়দানকে ছায়া দিতে গাছের সারিও রয়েছে। আছে অজু করার পুকুরও। ঘাট বাধানো পুকুরের চারিদিকে একসঙ্গে কয়েকশ মুসল্লি অজু করতে পারেন।
ঈদের দিন ঈদ জামাত ছাড়াও শাহী ঈদগাহের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের গৌরবগাথা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৭২ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের সূচনা হয় এখানে। সৈয়দ হাদি ও সৈয়দ মাহদি নামের দুই ভাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শাহী ঈদগাহে শহিদ হন। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশও হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো প্রখ্যাত নেতারা শাহী ঈদগাহ ময়দানে রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
ঐতিহ্যবাহী শাহী ঈদগাহে প্রতি ঈদে প্রায় দুই লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এবার ‘ক্ষমতাসীনবিহীন’ ঈদ জামাত চলমান প্রেক্ষাপটে অভিহিত হচ্ছে বলে জানান ঈদগাহ পাশের মহল্লা মিতালী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবু তাহের।
তিনি বলেন, ‘বাবার মুখে শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এ অবস্থার মুখে পড়তে হয়নি। ওয়ান-ইলেভেন সময়ও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এ রকম অবস্থা দেখিনি। সেই দেখা থেকে বলা যায় ক্ষমতাসীনবিহীন এবারই প্রথম।’
এ প্রসঙ্গে সিসিকের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘শাহী ঈদগাহ নামটির মধ্যেই ক্ষমতাসীনদের অংশ নেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। তবে সেই রেওয়াজ যাতে একেবারেই না ভাঙে, সে জন্য সিসিকের প্রশাসককে উপস্থিত রাখা হবে।’
খবরের কাগজ