পানিবন্দী লাখো মানুষ : আমাদের অট্টালিকাবিলাসী সিলেটী শিল্পপতিদের মানস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০১৭, ৯:০৪ অপরাহ্ণ
ইকবাল হাসান জাহিদ:
সিলেটের নিম্নাঞ্চলের একেকটা গ্রাম প্রায় দুইমাস থেকে পানিবন্দী। রাস্তাঘাট প্লাবিত। শহরের সাথে অনেক এলাকার যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন। ইতিমধ্যে ঘরবাড়ি ডুবতে শুরু করেছে। অকাল বন্যায় বৃহত্তর সিলেটের প্রায় সবকটি অঞ্চলের ধানক্ষেত পুরাপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ দিশেহারা। ধানক্ষেতের উপর যাদের ফ্যামিলি নির্ভরশীল, এখন তারা অনেকটা ভিখেরীর মতো নিঃস্ব। কৃষিনির্ভর এই মানুষজনের গোলায় নেই ধান, ঘরে নেই ভাত, পকেটে নেই টাকা। বাচ্চাদের মুখে নেই হাসি। মা-বাবার চোখে নেই ঘুম। বাকরুদ্ধ এ অঞ্চলের সকল স্তুরের মানুষ। সব মিলিয়ে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে গোটা সিলেটের অসংখ্য পানীবন্দী মানুষ।
ত্রাণ বিতরণও চলছে। পনেরো হাজার টাকা বিতরণ করতে ১৬জন ক্যামেরাম্যান। ১৭ জন স্বেচ্ছাসেবক। ১৮ জন সাংবাদিক। ১৯ জন মুরব্বি-দর্শক। শিল্পপতিদের ত্রাণের টাকায় একটা ফ্যামিলির দুই দিনের খাবার হয় না। জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণের খাবারে একটা পরিবারের পাঁচ দিনের চাহিদা মিটে না। সেদিন কয়েকজন কিছু টাকা বিরতণ করেছেন। এক লক্ষ টাকা বিতরণ করতে কেরিং খরচ পড়েছে তাদের ২০ হাজার টাকা। সাথে লস্করবাহিনি ছিলেন তিরিশজনের মতো। আহ আমাদের ত্রাণ।আমাদের ত্রাণবিলাসী মানস। মানসিক বিকারগ্রস্থতা আমাদেরকে তিলে তিলে কতটুকু অমানুষে পরিণত করছে।
দুর্যোগকে কেন্দ্র করে জনপ্রতিনিধীদের চলছে ভোটব্যাংক মজুত করার মহোৎসব। ক্যামেরা, সাংবাদিক, সেলফি, ত্রাণ বিতরণের জমকালো অনুষ্ঠান আর গরীবের পেটে লাত্থি দিয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিজের পেট ফুলিয়ে নেবার ধান্ধা। নিম্নাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে এখন নীরব কান্নার আওয়াজ। প্রতিটি বাড়িতেই এখন ভুখানাঙা মানুষের করুণ আর্তনাদ। এই আর্তনাদ শিল্পপতিদের চোখে পড়ে না। এই কান্নার আওয়াজ পুঁজিবাদী মানুষের কর্ণকুহরে পৌছায় না। মানুষের চর্মচক্ষু এই সকল অসহায় লোকদের আহাজারি দেখে না। তাদের চোখে শুধু ত্রাণীয় উল্লাস, উৎসব, বিত্তবৈভব আর দরীদ্র মানুষের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাওয়ার নারকীয় স্বপ্ন।
একজন জনপ্রতিনিধি তার এলাকায় গেছেন কয়দিন আগে। বন্যায় এই এলাকা প্লাবিত হয়েছে গত দুইমাস আগে। অসংখ্য পানিবন্ধী পরিবার তাকে দেখে হাতে আসমান পেয়ে বসেছে। তিনি হাটলেন, দেখলেন। পানি ভেঙে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি গিয়ে যেনো দায়িত্বের বোঝা কাঁধে লইলেন। আশ্বাস দিলেন- আমি যেহেতু এসেছি, কিছু একটা করবো। আপনাদের পাশে আছি পাশে থাকব। টোটালি নির্বাচনি ইশতেহার। কিন্তু কই তিনি। নাহ, তার কোনো খবর নেই, নেই তার চামচাদেরও খরব।
আরেকজন এমপি গতকাল নেমেছেন তার গ্রাম এলাকায়। কোমরপানি মাড়িয়ে দেখছেন বাজার-ঘাট। আশ্বাস দিচ্ছেন কিছু একটা করব অবশ্যই। অথচ এই বাজার ডুবেছে আজ থেকে প্রায় ২০-২৫ দিন আগে। এই এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দী একমাস থেকে। তার নির্বাচনি এলাকায় যে পানি উঠে ডুবে যায়, এই খবরটাও তিনি জানেন না। লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হলে কোন জনপ্রতিনিধির কি আসে যায়? এটা তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ইদানীংকালে একটা নতুন ভাইরাস যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে। সেটা হচ্ছে- ক্যামেরার সেলফী।দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় গিয়েই কোনো হতদরীদ্র, ভুখা নাঙা, কিংবা মুমুর্ষ ব্যক্তির সাথে সেলফি তুলেই ফেসবুকে আপলোড। অনেক নেতাতো মাথায় মাটি কাটার টুকুরি নিয়ে সেলফি দেয় ফেসবুকে। এই ফাইজলামির কবে শেষ হবে। আর কতকাল অসহায় ভুখা মানুষের পেটের উপর ভর করে ক্যামিক্যাল নেতাদের ভুরিভোজ সম্পন্ন হবে।
অথচ এই সিলেট সেই প্রবাসী অধ্যুষিত মানুষের স্বর্গরাজ্য। এই সিলেট গোটা দেশের অর্থনীতিতে রাখছে ব্যপক ভুমিকা। শুধুমাত্র প্রতি বছরকার যাকাতের টাকাই যদি বিতরণ করা হতো এসব নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের মাঝে, তবুও হয়তো মিটে যেতো প্রচুর পরিমাণ চাহিদা। ঘুচে যেতো অসংখ্য মানুষের দুঃখ।
আহ! সিলেটের শিল্পপতিদের বিলাসী জীবন। আহ! সিলেটের জনপ্রতিনিধীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা । আহ! সিলেটের কতিপয় পুঁজিবাদপুষ্ট মানুষের সেলফিশ মনোভাব। উন্নত দেশগুলোতে এরচে ভয়ানক রকমের দুর্যোগও আসে। অথচ তারা এসকল ভয়ানক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে খুবই কম সময় লাগে। রাষ্ট্র তাদের জন্য প্রচুররকমের দরদী মনোভাব লালন করে। বাসায় বাসায় গিয়ে মানুষের দুঃখ দুর্দশার খবর নেয়। মানুষ কেনো? একজন কুকুরকেও সহজে তারা মরতে দেয় না। নিজের নির্বাচনি এলাকার মানুষকে দুর্যোগে রেখে তাদের জনপ্রতিনিধির রাতে ঘুম হয় না। শিল্পপতিরা রাস্তায় নেমে যায় দুর্বল নিরীহ মানুষের সেবার খাতিরে।
অথচ, দেশসেরা রাগববোয়াল টাইপের শিল্পপতির অঞ্চল এই সিলেটের মানুষের অসহায়ত্ব এবং অট্টালিকাবিলাসী দানবীরদের দিকে তাকালে সেই বর্বর যুগের কথাই মনে পড়ে।
(সুরমানিউজ এর পাঠককলামে প্রকাশিত সব লেখা পাঠক কিংবা লেখকের নিজস্ব মতামত। এই সংক্রান্ত কোনো ধরনের দায় সুরমানিউজ বহন করবে না। সুরমানিউজ এর কোনো লেখা কেউ বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করতে পারবেন না।)