সাদা পাথর লুটের মামলার একমাত্র সাক্ষী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ৭:১৭ অপরাহ্ণ
সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর থেকে পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় মামলা করেছে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। শুক্রবার (১৫ আগস্ট) বিএমডির মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ আনোয়ারুল হাবিব বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলাটি করেন। এই মামলার একমাত্র সাক্ষী করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং বিভিন্ন টেলিভিশন নিউজকে।
এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কোনো মৌলিক সাক্ষী না দিয়ে দালিলিক সাক্ষী দিয়ে এজাহার দায়ের করা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয় বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি পরিবেশবিদরা মনে করছেন, পাথর ইস্যুতে এ ধরনের অযৌক্তিক কাজ পরবর্তীতে এই মামলার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করবে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১২ আগস্ট পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি হতে পাথর লুটপাটের ঘটনায় বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, বিভিন্ন টেলিভিশন নিউজকে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া হয়েছে। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া এই পাথর লুটপাটের ঘটনায় সিলেটের জেলা, উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিজিবি বিভিন্ন সময় অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। এছাড়া এ সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সও বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেছে। তাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্বশীলদের সাক্ষী না করে শুধুমাত্র গণমাধ্যমকে দালিলিক সাক্ষী করা এই মামলার দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হবে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ আছে, অজ্ঞাতনামা কিছু দুষ্কৃতকারী ব্যক্তি কর্তৃক গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ পরবর্তী সময়ে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন গেজেটভুক্ত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি হতে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে মর্মে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পাথর লুটপাটে অজ্ঞাতনামা আনুমানিক ১৫০০-২০০০ ব্যক্তি জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সরকারের গেজেটভুক্ত কোয়ারি হতে পাথর লুট/চুরি এ ধরনের কর্মকাণ্ড খনি ও খনিজসম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ এর ধারা ৪(২) (ঞ) এবং খনি ও খনিজসম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯৩(১) এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় মৌখিক নির্দেশনায় খনি ও খনিজসম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ এর ৫ ধারা অপরাধে ও দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৯নং ধারা ও ৪৩১নং ধারায় অভিযোগ দায়ের করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায়, সরকারি নির্দেশনায় ও সরকারি স্বার্থে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন গেজেটভুক্ত ভোলাগঞ্জ কোয়ারি হতে পাথর লুট/চুরির দায়ে দায়ী (অজ্ঞাতনামা) ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
এ বিষয়ে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সিলেট-এর সদস্যসচিব আব্দুল করিম কিম বলেন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনকে মামলায় স্বাক্ষী হিসাবে উপস্থাপন করাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে এই লুটপাটের বিষয়ে কেন স্বাক্ষী করা হলো না? স্থানীয় প্রশাসনের সামনেইতো এই লুটপাট হয়েছে। তাই এ নিয়ে জনমনে প্রশ্নের অবকাশ রয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, পাথর ইস্যুতে দায়িত্বশীলদের খামখেয়ালিপনা থাকলে পরবর্তীতে তা মামলার গ্রহনযোগ্যতা নষ্ট করতে পারে।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা বারের আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শুধুমাত্র মিডিয়াকে সাক্ষী করা কোনোভাই যুক্তিসঙ্গত নয়। শুধু দালিলিক, শুধু প্রচারমাধ্যম, শুধু গণমাধ্যম নিউজ সাক্ষী নয়। মৌলিক সাক্ষী হিসেবে স্থানীয় মানুষ দিতে হবে যারা এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত নয়। এবং ওই এলাকায় প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছেন তারা সাক্ষী হবেন। যেমন সংশ্লিষ্ট উপজেলা ইউএনও, ওসি, ভূমি কর্মকর্তাকে সাক্ষী করতে হবে এবং এই এজাহার সংশোধন করতে হবে।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষী করে করা এই মামলা বিচারকের সামনে উপস্থাপন করলে মামলার ভিত নষ্ট হবে। কারণ স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হলো দালিলিক সাক্ষী। একটি মামলার একমাত্র সাক্ষী শুধুমাত্র দালিলিক হতে পারে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় এ সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের গুরুত্ব বেশি। এ মামলায় জেলা প্রশাসকও সাক্ষী হওয়া উচিত। নিয়মে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এই মামলার আসামি হবে। কারণ এই খনিজসম্পদ সংরক্ষণ করার দায়িত্ব তাদের। তারা সংরক্ষণ করে নাই। এতে বুঝা যায় তারও এই লুটপাটে পরোক্ষভাবে জড়িত।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুদীপ্ত অর্জুন বলেন, বর্তমান আইনে এই ধরনের মিডিয়া রিপোর্টকে সাক্ষী ধরা হয়। কিন্তু সাদা পাথরের লুটপাটের এই মামলাতে শুধুমাত্র মিডিয়া রিপোর্টকে বেইজ ধরা হয়েছে। কিন্তু এই মামলার মূল সাক্ষী করা উচিত ছিল বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা, স্থানীয় যারা এই পাথর তোলায় প্রতিবাদ করছেন তাদের এবং স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের। পাশাপাশি এই মৌখিক সাক্ষীদের দাবিকে সমর্থন করার জন্য মিডিয়া রিপোর্টকে সাপোর্ট সাক্ষী করা যেত। তাই শুধুমাত্র গণমাধ্যমকে সাক্ষী করা এই মামলার দুর্বলতা হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
খবরের কাগজ








