সিলেটে বেতন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ চা শ্রমিকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০২৫, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটের বুরজান চা-বাগান। শাহপরান (রহ.) মাজার এলাকার পাশেই এ বাগান। জেলার অন্যতম বড় ও
পরিচিত বাগানটি। কয়েকশ’ শ্রমিক এ বাগানে কাজ করেন। বাগানের অন্তর্ভুক্ত আরও তিনটি শাখা বাগান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- কালাগুল, ছড়াগাঙ, লালিছড়া। শ্রমিকের সংখ্যা ৫শ’র উপরে। এই বাগানগুলোর শ্রমিকরা ২০ সপ্তাহ ধরে বেতন পাচ্ছে না। রেশন পাচ্ছে নামমাত্র। শ্রমিকদের দাবি- পাহাড়ের লতা-পাতা খেয়ে তারা কোনোমতো বেঁচে আছেন। বেতন না থাকার কারণে তারা অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এ নিয়ে মালিকপক্ষের কাছে বারবার দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসনকেও করেছেন অবগত। কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় গতকাল সিলেটে প্রায় সব বাগানের শ্রমিকরা একজোট হয়ে আন্দোলনে নামে। তিন ঘণ্টা তারা আম্বরখানা এয়ারপোর্ট সড়ক অবরোধ করে রাখে।
দুপুর সাড়ে ১২টায় অবরোধ শুরু করলেই প্রথমেই পুলিশ সেখানে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের আশ্বাস শ্রমিকরা মানেনি। কয়েক হাজার শ্রমিকের উপস্থিতি সেখানে। পরে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা যান। তারা গিয়ে সড়কে থাকা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে হাজারো যানবাহন আটকা পড়ে অবরোধ স্থলের উভয় পাশে। অবরোধের স্থান ছিল মালনীছড়া বাগানের কাছে। ফলে এয়ারপোর্ট থেকে দেশে ফেরা যাত্রীরা পড়েন ভোগান্তির মুখে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সেখানে। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের প্রতিশ্রুতি দিলে শ্রমিক নেতারা তাদের অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। বিকাল ৩টার কিছু পরে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে যায়। অবরোধ চলাকালে শ্রমিকরা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, বেতন ও রেশন না পাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তারা। বুরজান চা কোম্পানির অধীনে থাকা আড়াই হাজার শ্রমিকের বেতন-রেশন ও বোনাস বকেয়া পড়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা তিনবেলা খাবার খেতে পারছে না। পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে। মালিকপক্ষ বেতন দিচ্ছে দিচ্ছে বলে যাচ্ছে। কবে বেতন দেবে তার ঠিক নেই। এ কারণে বাধ্য হয়ে তারা সড়ক অবরোধে নেমেছেন। কেন এই অবস্থা, প্রশ্নের জবাবে বুরজান বাগানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাগান বন্ধই থাকে। এ সময় হচ্ছে বাগানের কলুমে সময়।
শ্রমিকদের তেমন কাজ থাকে না। তবে সব সময়ই শ্রমিকদের বেতন, রেশনসহ অন্যান্য সুবিধাদি দেয়া হতে থাকে। প্রতিটি বাগান এখন সংকটে। ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে বাগান কর্তৃপক্ষকে। কৃষি ব্যাংকে ঋণের আবেদন করলেও টাকা মিলেনি। পাশাপাশি নিয়মিত বেতন না দেয়ার কারণে শ্রমিকরা কাজও করেননি। ফলে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এতে করে বাগান অর্থ সংকটে পড়ায় গত ২০ সপ্তাহের তলব দেয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন। শ্রমিকরা জানিয়েছে, বেতন, বোনাস ও রেশন পরিশোধ, বসতবাড়ি নির্মাণ ও মেরামত, চিকিৎসা সেবা চালু ও ওষুধ প্রদান, চা বাগানের গাছ কাটা ও বিক্রি বন্ধসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন চা শ্রমিকরা। এতদিন তারা বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে এসব দাবি জানালেও কোনো কাজ হয়নি। চা শ্রমিক ও চা-বাগান রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক রঞ্জিত নায়েক রঞ্জু জানিয়েছেন, বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার কিংবা বাগান কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোনো কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। এ কারণে চা শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে সড়ক অবরোধ করেছে। বেলা আড়াইটার দিকে সদর উপজেলা ইউএনও খোশনুর রুবাইয়াৎ সহ সেনা সদস্যরা অবরোধ স্থলে যান। এ সময় ইউএনও শ্রমিকদের আশ্বস্ত করে জানান, আপনাদের সব দাবি সিলেটের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা আসেনি। সিদ্ধান্ত আসার পর কার্যকর করা হবে।
এ সময় তিনি শ্রমিকদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে নিয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। বলেন, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করা যাবে। প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তার এই আহবানে সাড়া দিয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করে বিকালে বৈঠকে বসেছেন চা শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির কার্যকরী সভাপতি রাজু গোয়ালা জানিয়েছেন, ইউএনও’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার কার্যালয়ে চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেছেন। বুরজান বাগানের সংকট উত্তরনের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, চা শ্রমিকরা তাদের বকেয়া তলব (বেতন) পেয়ে গেলে সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সিলেটের সড়ক অবরোধ সহ কর্মসূচিতে শুধুমাত্র বুরজান বা তার আওতাভুক্ত তিন বাগানের শ্রমিকরা অংশ নেয়নি। এতে সিলেটের সবক’টি বাগানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব থেকে দাবি জানিয়ে ঘোষণা দিয়ে রোববারের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, বৈঠকে থাকা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সমস্যার মূলে বাগান কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকরা। সুতরাং সমাধানের পথ খুঁজতে হবে তাদেরকে। প্রশাসন থেকে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সড়ক অবরোধ করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ কারণে আলোচনার পথ তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তারা।