ঘামে শ্রমে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মে ২০২৫, ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ
১২ বছরের সাব্বির। কাজ করে পান্থপথের একটি ওয়েলডিং শপে। সে প্রতিদিন এই কাজের জন্য পায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তাই ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করতে সে এ কাজকেই বেছে নিয়েছে। খবরের কাগজকে সে জানায়, তার বাবা অসুস্থ আর মা মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। কিন্তু মায়ের আয়ে তিন ভাই-বোন আর বাবা-মার পেট চলে না। তাই সে কাজ করে। এই কাজে টাকা বেশি তাই সে এটাই করে।
সাব্বির বলে, আমি দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। তখন বাবা সুস্থ ছিল, কাজ করত। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পর আর পড়তে পারিনি। এখানে কাজ করি।
ফার্মগেট থেকে ঝিগাতলা রুটে লেগুনার হেলপারি করে সাইদ হোসেন। বয়স ১৫ বছর। কিশোর বয়সে যখন তার লেখাপড়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় তখন তা ছেড়ে হেলপারি করছে। একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যদিকে পড়াশোনা নষ্ট করে পরিবারের আয়ের উৎস হতে তাকে এই কাজ করতে হয়।
সাইদ বলে, ‘যখন ঘরে খাওয়া থাকে না তখন পড়াশোনা করব কী করে। হেলপারির কাজে টাকা বেশি।’
শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, ‘যে বয়সে তাদের দুরন্তপনায় মেতে থাকার কথা, সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকার কথা সেই বয়সে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক শিশুই বিভিন্নভাবে শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। তাদের শ্রমে আসার মূল কারণ হচ্ছে পারিবারিক অসচ্ছলতা।’
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী সাব্বির-সাইদের মতো দেশে শিশুশ্রমিক আছে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। দেশে শিশুশ্রম বন্ধে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ থাকলেও এ পরিসংখ্যান বলছে দেশে বেড়েই চলেছে শিশুশ্রম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এই জরিপ আরও বলছে, দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এর মধ্যে ২০ লাখ ৯০ হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের মধ্যে আবার ২০ লাখ ১০ হাজার শিশুশ্রমিক কোনো পারিশ্রমিক পায় না। যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা। এ ছাড়া ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
বিবিএস ‘সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ ২০২৩’ প্রতিবেদন শিশুশ্রমের আরও গভীর চিত্র উঠে এসেছে। এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি খাতের ৪০ হাজার ৫২৫টি কারখানায় সব মিলিয়ে ৩৮ হাজার ৮ শিশু কাজ করে। তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছেলে, বাকিরা মেয়ে। এর মধ্যে মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) ২৪ হাজার ৯২৩ জন, পাদুকা উৎপাদনে ৫ হাজার ২৮১ জন, ওয়েল্ডিং কাজ বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজে ৪ হাজার ৯৯ এবং টেইলারিং ও পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ শিশু কাজ করে। আর শুঁটকি উৎপাদনে কাজ করে ৮৯৮ জন।
শিশু অধিকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুশ্রম রোধে সরকারি অনেক প্রকল্প থাকলেও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব এবং কঠোর আইন না থাকায় দেশে কমছে না শিশুশ্রম।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম অ্যান্ড প্লানিং) জাহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, একটি মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে তার শৈশব। এই শৈশবেই যখন সে চাপে পড়ে, সে বাধ্য হয় উপার্জন কিংবা কাজ করতে। তখন এটি তার মনে দাগ কাটে। এই তিক্ত অনুভূতি তার মন থেকে মোছে না। ফলে বড় হলে সে যারা সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় বা একটা নেগেটিভ মনোভাব পোষণ করে। যা তার পরিবার ও কর্মক্ষেত্র সবখানেই প্রভাব ফেলে। সে ভাবে যেভাবে কষ্ট করে সে বড় হয়েছে অন্যদেরও তাই করতে হবে। ওই ধরনের চাপ সে তার আশপাশের মানুষকে দিতে থাকে। আবার অনেক সময় এর উল্টোও হয়। অনেকে আবার মনে করে সে যে কষ্ট শৈশবে করেছে, তার পরিবার বা আশপাশের মানুষকে সে তা করতে দেবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি শিশুদের শ্রমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে পারিবারিক অসচ্ছলতা। অল্প বয়সে যখন তাদেরকে পরিবারের আয়ের উৎস হতে হয় তখনই তারা বিভিন্ন কাজে যায়। এর মধ্যে যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোতে মজুরি বেশি ফলে তারা ওই সব কাজে ঝোঁকে।’
সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স বিভাগের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকারি-বেসরকারিভাবে শিশুশ্রম বন্ধে অনেক প্রকল্প আছে। এর মধ্যে সরকারি প্রকল্পের সংখ্যা বেশি। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অর্থ বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পগুলোর সুফল পাচ্ছে না শিশুরা। এ ছাড়া শিশুদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধা দিতে চাওয়া হলেও যেহেতু তাদের শ্রমে যাওয়ার মূল কারণ পারিবারিক অসচ্ছলতা, তাই তারা এসব সুবিধা নিতে পারে না। কারণ এতে তার পরিবারের অবস্থার কোনো তাৎক্ষণিক পরিবর্তন বা সুফল মেলে না। এসব ক্ষেত্রে শিশুকে শ্রম থেকে সরিয়ে আনতে আমরা তিনভাবে কাজ করি। এর মধ্যে প্রথমত ওই পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করি। না হলে পরিবারের অন্য সদস্যকে ওই শিশুর বিকল্প হিসেবে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। আর শিশুটি যদি ১৪ বছরের বেশি বয়সী হয় তাহলে তাকে কোনো ঝুঁকিবিহীন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, শিশুশ্রম বন্ধ করতে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পগুলোকে যদি কার্যকর করা হয় তাহলে শিশুশ্রম অনেকটাই নিরসন সম্ভব। এ ছাড়া শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং শ্রম আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন। কোথাও শিশুশ্রম হলে তা চিহ্নিত করে তার বাস্তবসম্মত সমাধান করা প্রয়োজন।
দেশে শিশুশ্রম নিরসনে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
এ ছাড়া শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় শিশু নীতি-২০১১’, ‘শিশু আইন-২০১৩’, ‘বাল্যবিবাহ বিরোধ আইন-২০১৭’ এবং গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু কেবল নীতিতেই আবদ্ধ থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীরা।
তারা বলছেন, নীতিগুলোকে দ্রুত আইনে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নাহলে শ্রমে থাকা এই বিশালসংখ্যক শিশু বঞ্চিত হবে তাদের জীবনের স্বর্ণময় শৈশব থেকে। সুত্র-খবরের কাগজ