পথেই যাদের ‘শেষকথা’
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ৯:১১ অপরাহ্ণ
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তের পাশেই একটি ভ্যানের ওপর চার শিশু কিছু একটা নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছে। দূর থেকে ততটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাই একটু কাছে গিয়েই দেখা গেল, একটি পলিথিনের ভেতরে ড্যান্ডির জন্য তাদের এই টানা-হেঁচড়া। এর মাঝেই তাদের খুনশুটি করতে দেখা গেল। পরে সেই ড্যান্ডি সবাইকে ভাগ করে সেবন করতে দেখা যায়। তারপর ওই ভ্যানের ওপরে থাকা কয়েকটি বস্তা নিয়ে তারা বোতল কুড়াতে বেরিয়ে পড়ে।
এ সময় তাদের একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। আজ (২ অক্টোবর) বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে কারওয়ান বাজার রেলক্রেসিং পাশে মুক্তারের (১২) কাছে ড্যান্ডি সেবনের বিষয়ে জানতে চাইলে দেশ রূপান্তরকে বলে, ‘এটা খেলেই আমরা ভালো থাকি। এটা খাওয়ার পর ক্ষুদা কম লাগে। আমাদের থাকার জায়গা নেই, কেউ খাবারও দেয় না। আমাদের দেখলেই সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়।’
কোথায় রাত কাটে এই বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তার বলে, ‘আমাদের থাকার কোনো ঠিক নেই। কখনও কমলাপুর স্টেশন, আবার কখনো মেট্রোরেলের নিচে থাকি। আমাদের পথেই আসল ঠিকানা।’ কথা বলার এক পর্যায়ে তার সঙ্গীরা দৌঁড় দিয়ে তাকে ডাক দেয়। তাদের ডাক শুনেই ওই পলিথিনের ঠ্যান্ডি নিয়ে সেও দৌঁড় দেয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তের পেছনে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে দেখা গেছে, ‘কয়টা লাগবে, কয়টা লাগবে আসেন নেন’ এইভাবে গাঁজা ক্রেতাদের ডাকছে দুই শিশু। তাদের পাশেই এক যুবক গাঁজা নিয়ে বসে আছেন। এভাবে পুরো রেলপথ জুড়ে কয়েকজন শিশুকে এই কাজ করতে দেখা গেছে।
সেখানে এক শিশুকে এই কাজ কেন করছে জানতে চাইলে প্রথমে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। পরে ওই মাদকের দাম জানতে চাওয়ার ফাঁকে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওই শিশু বলে, ‘গাঁজা পুরিয়া বিক্রি হলে আমি কিছু কমিশন পাই। তাই দিয়ে ভাত খাই, আর ড্যান্ডি কিনি। এভাবেই চলে আমাদের জীবন।’
জানা গেছে, শিশুর সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ অক্টোবর বাংলাদেশে জাতীয় পথশিশু দিবস পালিত হয়। প্রতিবছর দিবসটি আসলেই পথশিশুদের নিয়ে কর্মশালাসহ নানা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ ও প্রস্তাবনা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। পথশিশুদের ভাগ্য বদলের জন্য তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। রাজধানীতে সরকারিভাবে পথশিশুদের জন্য দুইটি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। একটি রাজধানীর কমলাপুরে আরেকটি কারওয়ান বাজারে। এই দুই পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকে ১৫২ জন শিশু। যাদের মধ্যে ছেলে ১৩৬ আর মেয়ে ১৬ জন। এই দুই পুনর্বাসন কেন্দ্র দুটি নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ ফেইজ-২’ প্রকল্পের অধীনে পথশিশুদের নিয়ে একটি গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘দেশে ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চরম দারিদ্য, পারিবারিক অস্থিরতা এবং শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পটভূমি থেকে বেড়ে ওঠা শুরু হয় পথশিশুদের। অর্থনৈতিক চাপ প্রায়ই এসব শিশুকে শ্রমে বাধ্য করে, তাদের শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দেয় এবং দারিদ্র্যের একটি চক্রকে স্থায়ী করে। পিতামাতার অবহেলা, অপব্যবহার এবং পরিত্যাগসহ পারিবারিক কর্মহীনতা সরাসরি তাদের রাস্তায় বেরিয়ে আসতে প্রভাবিত করে।’
ওই গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘পথশিশুরা বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে জনগণের সহানুভূতি চাওয়া, অনানুষ্ঠানিক শ্রমে জড়িত হওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ কার্যকলাপের অবলম্বন করে।’
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ এর ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের মোট পথশিশুর প্রায় অর্ধেক (৪৮.৫%) ঢাকা বিভাগে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় ২২.৭ এবং ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় ১৮.৩ শতাংশের বসবাস। সবচেয়ে কম পথশিশু সিলেট বিভাগে (৪.০%)। মোট পথশিশুর ৮২ শতাংশ ছেলে, ১৮ শতাংশ মেয়ে। আর অর্ধেকের বেশি পথশিশুর বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। পথশিশুদের ১২ শতাংশই মাদকাসক্ত।
পরিসংখ্যান বলছে, ‘এই শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন (৩৩ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পায় না। প্রায় অর্ধেক শিশু মাটিতে ঘুমায়, পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরা বা একটি পাতলা কম্বল নিয়ে। প্রায় ৭ শতাংশ শিশু সম্পূর্ণ একা ঘুমায়। ১৭ শতাংশ শিশু কয়েকজন একসঙ্গে মিলে ঘুমানোর মাধ্যমে সুরক্ষা ও স্বস্তি খোঁজে। জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ ২০.৯ শতাংশ। ভিক্ষাবৃত্তি করে ১৮.৪ শতাংশ। গাড়ি ও নির্মাণ খাতে কাজ করে ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া চায়ের দোকান, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করে ১৪.৮ শতাংশ।’
পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের সহকারী কার্যক্রম পরিচালক এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ (প্রশাসন-৩ শাখা) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর কমলাপুরের পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে এখন ৭৭ জন শিশু। এর মধ্যে মেয়ে শিশু আছে ১৬ জন। আর কারওয়ান বাজার পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে আছে ৭৫ জন, যাদের সবাই ছেলে।’
আজ জাতীয় পথশিশু দিবসে তাদের নিয়ে বিশেষ কোনও আয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজ তেমন কোনও আয়োজন নেই। তবে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিবসটি নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন রয়েছে। ওইদিন ওই দুই কেন্দ্রে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। তবে এমনিতেই ওই দুই সপ্তাহে একদিন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয় বলেও জানান তিনি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পথশিশুদের নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমে তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। সেই সংখ্যা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের সুরক্ষায় সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়ালে পথশিশুরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
দেশ রূপান্তর