অপসারণ হচ্ছে ইউপি চেয়ারম্যানরা
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ৭:১০ অপরাহ্ণ
বিগত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করেছিল অন্তর্বর্তীকালিন সরকার। তবে তৃণমুলে সাধারণ নাগরিকদের সেবার কথা বিবেচনা করে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)’র চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়নি। বর্তমানে দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারদেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থাকা প্রায় ১-২ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ করলেও ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারেনি স্থানীয় সরকার বিভাগ। এদিকে সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে থাকায় ইউপি পরিষদে লাখ লাখ জনগণ নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের পদত্যাগের দাবি তোলা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা বিগত হাসিনা সরকারের আর্শিবাদপুষ্ট। তাদের পরোক্ষ সহায়তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার সুদূর প্রসারী চক্রান্ত থাকতে পারে। বিভিন্ন স্থানে যেসব সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে এইসব ইউপি চেয়ারম্যানদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের কথা বলেছেন। এপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আগমী উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের আইন অনুযায়ী, পদত্যাগ করলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ শূন্য হবে। এছাড়া পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কারণে চেয়ারম্যান পদ শূন্য হলে নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবে। তবে শূন্য হওয়া ছাড়াও আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামী বা দণ্ডিত হলে, পরিষদের স্বার্থ পরিপন্থ’ী কাজ করলে চেয়ারম্যানদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে সরকার। এছাড়াও দুর্নীতি, অসদাচরণ বা নৈতিক স্থলনজনিত কোন অপরাধ কিংবা বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ আইন অনুযায়ী তাদেরকে অপসারণ করতে পারে সরকার। তারপরও অতীতো প্রায় ১ হাজার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি অনিয়য়ের অপরাধ প্রমানিত হলেও ব্যবস্থা নিতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব ও প্রশাসন বিবেশষজ্ঞ আবু আলম শহীদ খান বলেন, গত বেশ কয়েক বছর ধরে এমন সব নির্বাচন হয়েছে যে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষ এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তাদের অপসারণ চাইছে। এটা বাস্তবায়ন করা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। বর্তমান সরকার অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে যেমনটি করেছে, ঠিক একইভাবে ইউপি পরিষদের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত হবে।
গতকাল শনিবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, স্থানীয় সরকারের সংস্কারের দাবিগুলো উত্থাপন করা দরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে।জাতীয় থেকে স্থানীয় সরকার সকল পর্যায়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। দলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ কর্তৃত্ব, জনবল, আর্থিক সামর্থ্য ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে স্থানীয় জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়। বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো অত্যন্ত প্রকট। গত সোমবার এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানদের এখনই অপসারণ করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে যে সব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। আগামীতে পযাংক্রমে সব চেয়ারম্যান অপরসারণ করা হবে।এর মধ্যে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউপি চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। আগামীতে আরো কিছু হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অনেকেই চলে যান আত্মগোপনে। তাদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। স্থানীয় সরকারের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন খোলা থাকলেও অনেক জায়গায়ই নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানরা পরিষদে যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানরা যে সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন সে সব জায়গায় তালাও ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সোমবার নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় সেখানকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। সারাদেশের বেশ কিছু জেলায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে মিছিল কিংবা পরিষদ ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও চলছে। আওয়ামী লীগ নেতা এমন কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদেরকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে সাড়ে চার হাজারের ওপরে ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এসব ইউনিয়ন পরিষদের বেশিরভাগেই নির্বাচন হয়েছে দুই বছর আগে। গত ২০১৮ সালের পর স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচন বয়টক করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে গত ৬ বছরে হাত গোনা কিছু ইউনিয়ন, উপজেলা বাদে বেশিরভাগেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের উপস্থিতি ছাড়াও এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এসবের অনেকগুলো নির্বাচন নিয়ে রয়েছে অনিয়ম কারচুপির অভিযোগ। এমন অবস্থায় সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের যে সব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন সে সব জায়গায় কাজ চালাতে প্যানেল চেয়ারম্যান বা প্রশাসক নিয়োগ হিসেবে নির্বাহি অফিসারকে দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান নেয় সরকার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার। কারণ অনেকেই আসামি হওয়ার পর থেকে ইউপি চেয়ারম্যানরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। সেখানে কোন কাজকর্ম হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে একাধিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ এলাকায় অবস্থান করলেও দপ্তরে বসছেন না। একজন নির্বাহি কর্মকর্তা হিসেবে সকল ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা খুবই কষ্টের। তাছাড়া জনবলের অভাব রয়েছে।
সেমিনারে স্থানীয় সরকার বিভাগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, আমরা সংস্কার চাই নাকি কাঠামোগত বিপ্লব চাই সেটা সুস্পষ্ট করতে হবে। সামনের দিকে এগোতে হলে সরকারি ও বেসরকারি- উভয় পক্ষকে একসাথে কাজ করে যেতে হবে। সংস্কারে নাগরিক সমাজ যেমন একটি অংশ, আমলাতন্ত্রকেও এর অংশীজন হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে, তৃণমূল জনগণের কাছ থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে। প্রস্তাব হতে হবে পূর্ণাঙ্গ, যা সমঝোতার মাধ্যমে সংস্কার করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগ অবশ্যই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে ভূমিকা রাখবে। সকল সংস্কারের লক্ষ্য হতে হবে সুশাসন কায়েম করা ও জনসেবা নিশ্চিত করা।
সেমিনারে স্থানীয় সরকার বিভাগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, আমরা সংস্কার চাই নাকি কাঠামোগত বিপ্লব চাই সেটা সুস্পষ্ট করতে হবে। সামনের দিকে এগোতে হলে সরকারি ও বেসরকারি- উভয় পক্ষকে একসাথে কাজ করে যেতে হবে। সংস্কারে নাগরিক সমাজ যেমন একটি অংশ, আমলাতন্ত্রকেও এর অংশীজন হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে, তৃণমূল জনগণের কাছ থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে। প্রস্তাব হতে হবে পূর্ণাঙ্গ, যা সমঝোতার মাধ্যমে সংস্কার করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগ অবশ্যই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে ভূমিকা রাখবে। সকল সংস্কারের লক্ষ্য হতে হবে সুশাসন কায়েম করা ও জনসেবা নিশ্চিত করা।