‘দুর্যোগে সিলেট’ চিন্তিত ড. মোমেন ও মেয়র আনোয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২৪, ১১:২৯ অপরাহ্ণ
নানা দুর্যোগের মুখে পতিত সিলেট। একটার পর একটা দুর্যোগ লেগেই আছে। যেন পিছু ছাড়ছে না। এতে হচ্ছে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ও সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। আর এসব দুর্যোগের প্রধান উপলক্ষ হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অনেক আগে থেকেই ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনে অবস্থিত ছিলেন। নতুন করে এতে যুক্ত হয়েছে হঠাৎ বন্যা। এবার এসেছে পাহাড় ধস। এই তিন দুর্যোগ নিয়ে বর্তমান সময়ে সিলেটবাসীও শঙ্কিত।
সোমবার সিলেট নগরীর চামেলীবাগে টিলা ধসে একই পরিবারের তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ওই এলাকায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক নেমে এসেছে। পাশেই টিলা। রাতে ঘুমাতে ভয় পান এলাকার মানুষ। স্থানীয় ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, চামেলীবাগ এলাকায় টিলা ধসের ঘটনায় ১৭টি পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আরও যারা বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছেন তাদেরও সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, টিলার নিচে এখন বসবাস করতেই মানুষ ভয় পাচ্ছে। বৃষ্টি হলে লোকজন নির্ঘুম রাত কাটান। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে পাহাড় ও টিলার পাদদেশ থেকে বসতি সরিয়ে নিতে হবে বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলায় পাহাড় টিলায় ঠিক কতো সংখ্যক লোক বসবাস করে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে। তবে সিলেট সদর, সিটি করপোরেশন, জৈন্তাপুর এলাকায় বসবাসকারীর সংখ্যা বেশি। পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের মতে, ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সংখ্যা হবে অর্ধলাখ। গত এক দশকে সিলেটে পাহাড় ও টিলা কেটে তার পাদদেশে হাজার হাজার মানুষ বসতি গেড়েছে। মূলত ভূমি দখলে নিতে এসব প্রক্রিয়া করা হয়। নগরের হাওলদারপাড়া, এটি ৮ নম্বর এলাকায় অবস্থিত। এই এলাকায় অবাধে পাহাড় ও টিলা কেটে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। আর এতে জড়িত খোদ জনপ্রতিনিধিরাও। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সাবেক থেকে বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে একইভাবে পাহাড়ি টিলা কেটেই যাচ্ছে। আর কাটা অংশে নির্মাণ করছেন বসতি। গত বছর টিলা ধসে ওই এলাকায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই আল হাদী জানিয়েছে, আমরা বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। গত তিন বছরে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত এই পরিবেশকর্মীর। এদিকে, গত ৫-৬ বছর ধরে হঠাৎ বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যায় সিলেট।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের মানুষ প্রতি বছরই উজানের ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সিলেট নগর এলাকার নিম্নাঞ্চলও ডুবে যায়। নগরের বন্যা এখন বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক মাসের বেশি সময়ের জন্য যুক্তরাজ্যে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বন্যার কারণে তিনি ছুটি সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন। এখন মেয়র নিজেও ভাবছেন বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে। সিলেট নগরে বন্যা পরিস্থিতি কমাতে হলে নগর অংশে সুরমার প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং ও নগররক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি। এনিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের একটি প্রস্তাবনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আর বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য টাকার সংস্থান করতে বিদেশে দাতাসংস্থা খুঁজছেন মেয়র আনোয়ার। ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেটে এক দশক আগে তেমন বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেড়েছে। চলতি মাসে সিলেটে কয়েক দফা ভূমিকম্প হয়েছে। বড় ভূমিকম্প হলে সিলেটে বিপর্যয় ঘটবে। এর থেকে উত্তরণের জন্য এখন বিকল্প পথ খোলা নেই। এই অবস্থায় উদ্ধারে সক্ষম যন্ত্রপাতি ও লোকবল রাখা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।
এদিকে, সিলেটে টিলা ধসের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, টিলা কেটে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ আসলে এখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। গতকালের মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছি। এধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে আমাদের সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে সিলেট প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালের বন্যায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিলেট। এবারেও বন্যা হয়ে ক্ষতির মুখে সিলেট। বজ্রপাতে সমপ্রতি ঘন ঘন প্রাণহানি ঘটছে এ অঞ্চলে। এ ছাড়া ঘন ঘন হচ্ছে ভূমিকম্পও। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সিলেটের জন্য ‘ক্লাইমেট প্রকেটশন ফান্ড’ গঠন করতে চাই। যাতে সহজেই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, পরবর্তী পদক্ষেপে জিরো টলারেন্স। জেলা প্রশাসন, স্থানীয় কাউন্সিলর ও এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। টিলা ধসের ঘটনায় নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক ও ত্রাণ সহায়তা করা হয়। হঠাৎ বন্যায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লোকজনকেও সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।