আজও কেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’, কী এর ইতিহাস?
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০৯:৪৩,অপরাহ্ন ০২ মে ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই গ্রাম থেকে শহরের প্রতিটি পাড়া- মহল্লায় যেন হৈ হুল্লোড় পড়ে যায়। এরপরই টেলিভিশন ও রেডিওতে বাজতে শুরু করে একটি গান। সেই গানটি না বাজলে যেন মনেই হয় না, ঈদ এসেছে। গানটি ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ’…
রোজার ঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কালজয়ী গানটি। এক মাস সিয়াম সাধনার পর সবাই যখন ক্লান্ত, তখন ঈদের বাতাসে স্নিগ্ধতা বয়ে আনে এই গান। গানের সঙ্গে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। বাঙালির ঘরে ঘরে বেজে ওঠে ঈদ আনন্দ। এই গানটি ছাড়া বাঙালির ঈদ যেন পূর্ণতা পায় না।
কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের অনুরোধে নজরুল ১৯৩১ সালে গানটি লিখেছিলেন। একুশ শতকে এসেও এটি সমান জনপ্রিয়। পরবর্তী সময়ে রোজার ঈদ নিয়ে অনেকে গান লিখেছেন, কিন্তু নজরুলের গানকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি কোনো গান।
গানের প্রথম গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিচারণ থেকে এই গানটি সৃষ্টির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়।
আব্বাসউদ্দিন একদিন কাজী নজরুল ইসলামকে বললেন, কাজীদা, বাংলায় একটা ইসলামি গান হলে কেমন হয়? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান। কথাটি কবির মনে লাগলো। বিদ্রোহী কবি তার চেতনা নিয়ে জেগে উঠলেন। নজরুল পাল্টা বললেন, আব্বাস, তুমি ভগবতীবাবুকে বলে তার সময় নাও, আমি ঠিক বলতে পারি না। তিনি সময় দিলে আমি দেবো।
পরে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ ভগবতীবাবুকে-অর্থাৎ গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সাল-ইন-চার্জকে জানালেন। কথাটি শুনে তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বলে বসলেন, না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
তখন অবশ্য তিনি এর লাভ-ক্ষতি চিন্তা করেননি। এতে মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলেন আব্বাসউদ্দিন। এর প্রায় ছয় মাস পর আব্বাসউদ্দিন অফিস থেকে গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সালে গেলেন। দেখেন, একটা ঘরে বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী আর বৃদ্ধ ভগবতীবাবু বেশ হাসি-খুশি গল্প করছেন। আব্বাসউদ্দিন নমস্কার দিতেই বৃদ্ধ বললেন, বসুন বসুন। তিনি বৃদ্ধের রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলেন, এই-ই তো উত্তম সুযোগ।
আব্বাসউদ্দিন বলে ফেলেন। বলে ফেলেন তার সে পুরানো কথা। ‘যদি কিছু মনে না করেন- সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী’? এতে ভগবতীবাবু হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি! আচ্ছা, করা যাবে’।
তখন পাশের ঘরে কাজীদা (কাজী নজরুল ইসলাম) ছিলেন। আব্বাসউদ্দিন নজরুলকে বললেন, ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা তার কাছে গান শিখছিলেন। নজরুল বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে’। এরপর ইন্দুবালা চলে গেলেন। নজরুল পান আর চা আনতে বললো দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধা ঘণ্টার মধ্যেই লিখে ফেললেন ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…’। ব্যস হয়ে গেলো গান। তখনই সুর যোগ করে শিখিয়ে দিলেন আব্বাসউদ্দিনকে।
এরপর আবার পরের দিন লিখলেন ‘ইসলামেরই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’। গান দু’খানি লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড হয়। এর মধ্যে দুটি ইসলামি গান লিখে অধৈর্য হয়ে যান নজরুল। তার চোখে-মুখে আনন্দ খেলা করতে থাকে।
এরপর এলো রেকর্ডের সময়, তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। এদিকে গান দুটি মুখস্থও হয়নি আব্বাসউদ্দিনের। নজরুল নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আব্বাসউদ্দিনের চোখ বরাবর হাত দিয়ে নজরুল নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আব্বাসউদ্দিন গেয়ে চললেন। এ হলো প্রথম ইসলামি গান রেকর্ড।
নজরুল ১৯৩১ সালের শেষের দিকে গানটি লিখেন। রেকর্ড হওয়ার মাস দুয়েক পরই ছিল ঈদুল ফিতর। আর ঈদের সময়েই রেকর্ডটি বাজারজাত করে গ্রামোফোন কোম্পানি। রেকর্ড নং-৪১১১, প্রকাশকাল ছিল ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আর এ রেকর্ডটির সুবাদেই শ্রোতাদের কানে প্রথমবারের মতো পৌঁছে যায় গানটি।
৯০ বছর আগের লেখা গানটি এখনো কেন সমান জনপ্রিয়? এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই। এ বিষয়ে দেশের বরেণ্য গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা মনে করেন, এই গানের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে গানের কথাগুলো। গানের প্রথম দুই লাইনেই কবি মুসলিমদের মনের কথা বলে দিয়েছেন। পাশাপাশি উৎসবের নিখুঁত আমেজ রয়েছে গানটির সুরেও। তাই আজও শ্রোতাকে আঁকড়ে ধরে আছে গানটি।
ঈদ নিয়ে আরো অনেক গান হয়েছে। কিন্তু এই গানের সমকক্ষ কোনো গানই হয়নি। এর কারণ হিসেবে সঙ্গীত বিশারদগণ মনে করেন, কয়েকটি প্রজন্ম এই গানটি ছোটবেলা থেকে শুনে বড় হয়েছে। ফলে এটি এমনভাবে সবার মনে ও মননে গেঁথে গেছে যে, অন্য গান আর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তাছাড়া সুর ও কথার অদ্ভুত এক সমন্বয় রয়েছে এখানে। একটি গানকে শ্রোতাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। নজরুলের লেখা ঈদের এই গানটি একক ও সমবেত কণ্ঠে অনেকেই গেয়েছেন। তবে সমবেত কণ্ঠেই গানটি ভালো লাগে।
সামাজিক বার্তা থাকায় ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটি সব মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে মনে করেন অনেক গীতিকার। পাশাপশি ঈদের মূল উদ্দশ্যেও নিহিত আছে গানটিতে। ঈদে গরীব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়াতে হয়। তাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে হয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট উঠে এসেছে গানটির কথায়। কথাগুলো পবিত্র কোরআনের সঙ্গে এমনভাবে মিলে গেছে যে ভালো না লেগে উপায় নেই।
এ ছাড়াও আরবি ফারসিসহ বহু বিদেশি ভাষার চমৎকার শব্দযোগ রয়েছে গানটিতে। ফলে অন্যরকম আবেদন সৃষ্টি করেছে এই গান। তাছাড়া গানটির রচিয়তা ও সুরকার এক ব্যক্তি। কোনো গানের রচিয়তা ও সুরকার একজন হলে তার কথা ও সুরে যে সমন্বয় আসে তা অন্য কোনো গানে আসে না।
মুসলমানদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষও গানটির সুরে মুগ্ধ হন। কারণ, দেশি-বিদেশি ভাষার শব্দের সমন্বয় ও সুর গানটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ফলে মুসলিমদের পাশাপশি অমুসলিমদের নিকটও গানটি পছন্দের। তাইতো আজও মানুষের মুখে-মনে বাজে সেই গানটির কথা-সুর
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ।
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।