কোথায় গেল দেশি ল্যাপটপ DOEL
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ অক্টোবর ২০২১, ১২:২৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
মাত্র ১০ হাজার টাকায় দোয়েল নামে দেশি ল্যাপটপ বিক্রি শুরু করেছিল টেলিফোন শিল্প সংস্থা। সে উদ্যোগের ১০ বছর হয়ে গেল, কিন্তু বাজারে জনপ্রিয়তা পায়নি এ ল্যাপটপ। নিভুনিভু হয়ে এখনও চলছে এ প্রকল্প।
জাতীয় পাখির নামে দেশের নিজস্ব ব্র্যান্ডের ল্যাপটপের নাম রাখা হয় দোয়েল। শুরুতে বাজারে বেশ সাড়াও পড়ে, কিন্তু তা কমতেও সময় নেয়নি। অপ্রতুল সার্ভিস সেন্টার, দক্ষ কর্মীর অভাব, সরাসরি যন্ত্রাংশ আমদানি করতে না পারা, আমদানিতে উচ্চ শুল্ক এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না থাকা, নতুন প্রকল্প না নেয়াসহ নানা সমস্যায় গত এক দশকেও আর ডানা মেলা হয়নি দোয়েলের।
২০১১ সালের অক্টোবরে দোয়েল ল্যাপটপের উদ্বোধন হয়। বাজারে বৈশ্বিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপের চেয়ে দোয়েলের দাম কম হলেও তা জনপ্রিয়তা পায়নি। শুরু থেকেই এ ল্যাপটপে নানা সমস্যা দেখা দেয়, যেমন অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া, চার্জ না থাকা, স্পিড কম, হ্যাং হওয়া, অপারেটিং সিস্টেম ঠিকমতো কাজ না করা ইত্যাদি। আবার এসব সমস্যা সমাধানে কোনো সার্ভিসও পাননি গ্রাহকরা। এতে একপর্যায়ে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
পরবর্তী সময়ে আবার চালু হয় দোয়েলের উৎপাদন, কিন্তু তত দিনে ক্রেতারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। প্রচারের অভাবসহ নানা সমস্যার কারণে এটি আড়ালেই থেকে যায়।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) থেকে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দে ল্যাপটপ উৎপাদন শুরু করা হয়। যন্ত্রাংশের প্রায় সবই বিদেশ থেকে এনে দেশে অ্যাসেমব্লি (সংযোজন) করা হয়। ধীরে ধীরে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত যন্ত্রাংশ দেশে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও নেয়া হয়। সেটাও আর হয়ে ওঠেনি।
টেশিস এখনও শুধু বাইরে থেকে পার্টস এনে দেশে সেগুলো জোড়া দেয়ার কাজ করছে। বিভিন্ন কোম্পানি এরই মধ্যে ল্যাপটপের বিভিন্ন পার্টস দেশেই উৎপাদন শুরু করেছে। টেশিস এক যুগেও সে পথে হাঁটতে পারেনি। তা ছাড়া এত দিনেও কোনো বড় ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়নি দোয়েলকে ঘিরে।
টেশিস নিজেরা যন্ত্রাংশ আমদানিও করে না। তৃতীয় পক্ষের আমদানি করা যন্ত্রাংশ নিজেরা সংযোজনের কাজ করছে। এতে উৎপাদন খরচও বেশি পড়ে যায়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ল্যাপটপ যন্ত্রাংশের সংকট তৈরি হয়। ফলে যারা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী তারা ঠিকমতো সাপ্লাই দিতে পারে না। ফলে দামও বেড়ে যায়।
সম্প্রতি টেশিস যন্ত্রাংশ আমদানির উদ্যোগ নিলেও দেশীয় শিল্প সুরক্ষা দিতে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ আমদানিতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হওয়ায় এ আমদানিও আটকে আছে।
জানতে চাইলে দোয়েলের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘২০১১ সালে আমরা অনেক কম দামে ল্যাপটপ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তখন মালয়েশিয়া থেকে অ্যাসেমব্লিং করে নিয়ে আসা হতো। ১০ হাজার টাকায় ল্যাপটপ দিয়েছে, অথচ তখনকার সময় মাইক্রোপ্রসেসর কিনতেই ১০ হাজার টাকা লাগত। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কম দামে ল্যাপটপ দিতে, কিন্তু এত কম দামে তো না। যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের এটা বোঝা উচিত ছিল। মানুষের উৎসাহ কমে গিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘কমোডিটি বাজারে ছাড়লেই হবে না। আপনাকে সার্ভিস দেয়ার জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। আপনি নতুন একটা ল্যাপটপ কিনে নিয়ে আসলেন, এটির যেকোনো সমস্যা হতে পারে। তখন আপনি কোথায় নিয়ে যাবেন। এমন হয়েছে, অনেকের একটু প্রবলেম হলে সেটা আর তিনি রিকভারি করতে পারেননি। এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
‘আমরা নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা বা বড় প্রজেক্ট পাইনি। এখনও শুধু অ্যাসেমব্লিং হয়। কিছু পার্টস উৎপাদনের জন্য কোনো প্ল্যান্ট নেই। কোনো প্রকল্পও নেই। সে ক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্প বা প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ পেলেও ভালো। এমন বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে আগানো হয়ে ওঠেনি। তবে এখন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
১০ বছরের টেশিস
নিজেদের প্ল্যান্টে গড়ে দিনে ১০০০ ল্যাপটপ সংযোজনেরর সক্ষমতা থাকলেও গত ১০ বছরে এই ব্র্যান্ডটি ৮০ হাজারের কিছু বেশি ল্যাপটপ বিক্রি বা সরবরাহ করেছে, যার বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রকল্পে জোগান দেয়া হয়েছে। মাত্র ২০ হাজারের মতো ল্যাপটপ গেছে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে।
অথচ ২০১৯ সালে এক অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, দেশে পাঁচ কোটি ল্যাপটপের চাহিদা রয়েছে। দোয়েল পর্যন্ত ১১টি মডেলের ল্যাপটপ উৎপাদন করেছে। এখন বাজারে দোয়েলের ১৫ হাজার টাকা থেকে ৭৫ হাজার টাকা দামের ল্যাপটপ পাওয়া যায়।
এত বছরেও সার্ভিস সেন্টার বা বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি দোয়েলের। দোয়েল ল্যাপটপ কিনতে হলে, বিটিসিএলের টেলিফোন বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে যেতে হয়, তাও মাত্র সাতটি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। দোয়েলের কোনো প্রচারও নেই।
রাজধানীর রমনা ও নীলক্ষেতে বিটিসিএল অফিসে দোয়েল বিক্রি করা হয়। শেরেবাংলা নগরে বিক্রয়কেন্দ্র করা হলেও সেখানে বিক্রি শুরু হয়নি। আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনে একটি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। ঢাকার বাইরে আছে টঙ্গী, খুলনা ও রাজশাহীতে। ফলে দেশের প্রান্তিক এলাকায় একজন ক্রেতা ল্যাপটপ কিনলে স্থানীয়ভাবে সার্ভিস পান না।
টেশিস বলছে, দোয়েল থেকে প্রায় ১৬ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। এক দশকে ৩৪১ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৩২৫ কোটি টাকা।
টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল হায়দর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এখন সরাসরি যন্ত্রাংশ আনার উদ্যোগ নিয়েছি; কিন্তু টেশিসকে এসব পণ্য আনার ক্ষেত্রে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হয়। এত শুল্ক দিয়ে তো ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তাই আমরা শুল্ক ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করছি।
‘আমরা যখন সরাসরি আনা শুরু করব, তখন আমাদের উৎপাদন ও পণ্যের বাজার বাড়বে। শুরুতেই যে একটা ধাক্কা খেল, তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে টেশিস।’