কোরআনের প্রথম আয়াত নাজিলের ঘটনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ আগস্ট ২০২০, ১১:০৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
মক্কা মুকাররমা থেকে পূর্ব দিকে তিন মাইল ব্যবধানে অবস্থিত জাবালে নূরের ((নূর পর্বতের) গুহায় মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্জনবাস অবল্বন করেছিলেন। এ দিন থেকে ঠিক ছয় মাস পূর্বে এ গুহাতেই হজরত জিবরাঈল আমিন তাঁকে নবুওত প্রাপ্তির সুসংবাদ শুনিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর তিনি দেখা দেননি।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অপেক্ষায় ব্যাকুল দিন কাটাচ্ছিলেন। তিনি অপেক্ষা করছিলেন নিজের মালিক স্রষ্টার পক্ষ থেকে নতুন কোনো পয়গাম শুনার জন্য। এমনি সময় হঠাৎ করে মহান স্রষ্টার বাণীবাহক দূত হজরত জিবরাঈল আমিন দেখা দিলেন। এভাবে জিবরাঈল আমিনকে নিজের সামনে উপস্থিত দেখে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা কি হয়েছিলো তা আন্দাজ করা যায় না। কারণ, তা উপলব্ধি করা কোনো মানুষের সাধ্যের বিষয় নয়। এটি ছিলো নবুওতের ব্যাপার; নবীর পক্ষেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব।
হজরত জিবরাঈল (আ.) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে বলেন: ‘ইকরা’(পড়ুন)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি পড়তে পারি না।’ কথা শুনে জিবরাঈল আমিন তাঁকে বুকে জড়িয়ে সজোরে চাপ দিলেন। তিনি অত্যন্ত কষ্ট অনুভব করলেন। জিবরাঈল আমিন তাঁকে ছেড়ে দিয়ে আবারো বললেন: اقْرَأْ (পড়ুন)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বর উত্তরই দিলেন যে, আমি পড়তে পারি না। এ অবস্থা তিন বার ঘটল। তাপর জিবরাঈল আমিন আল্লাহ তায়ালার পয়গাম পাঠ করলেন:
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ
خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ
الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ
عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
অর্থাৎ:
পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।
পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু,
যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।
সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম শব্দটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়, সেটি ছিলো ‘ইকরা’(পড়ুন)। বস্তুত: এ শব্দটিই প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মৌল এবং তার ভবিষ্যতের নির্যাস।
কোরআনুল কারিমের ত্রিশতম পারায় সূরা কদরে ইঙ্গিত করা হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আমি এ (কোরআন)-কে শবে-কদরে অবতীর্ণ করেছি। আর তুমি জানো এ শবে-কদর কি? শবে-কদর (কদরের রাত) হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (এ রাতেই বিশ্ব মানবতাকে এক অনন্ত স্থায়ী জীবন ব্যবস্থা দান করা হয়েছে যার ওপর আমল করে মানবতা তার উৎকর্ষের শীর্ষে আরোহন করতে পারে)। এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং রুহ (জিবরাঈল আমিন) নিজেদের পালনকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী যাবতীয় কর্ম সম্পাদনকল্পে (আকাশ থেকে) নেমে আসেন। (এ রাতে) রয়েছে কল্যাণই কল্যাণ ভোরের আলো ফুঠে উঠার সময় পর্যন্ত।
কোরআন নাজিলের প্রথম দিনেই হজরত খাদিজাহ (রা.) হজরত আবুবকর (রা.)হজরত আলী (রা.) ও হজরত যায়েদ (রা.) ইসলামের দাওয়াত কবুল করে নিয়ে ইসলামি ইতিহাসে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন।
ওহী নাজিলের প্রথম দিনেই এই চার পবিত্রাত্না আল্লাহ তায়ালা পয়গামের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাসহকারে একাত্নতা ঘোষণা করে এমন এক গৌরব অর্জন করে নেন যা আর কেউ অর্জন করতে পারেনি।
ইসলামের কাননে বিকশিত এ চারটি কুসুম এ সত্যের সাক্ষ্য যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র সুস্নিগ্ধ চন্দ্র কিরণ অপেক্ষা নির্মল, ফুলের সুবাস অপেক্ষা মোহনীয় এবং কলি অপেক্ষা বহুগুণ পবিত্র। তিনি যা কিছু বলেন, সত্যে পরিণত হয়। (হজরত মুহাম্মাদ, ওহী নাজিল থেকে হিজরত পর্যন্ত,১৬-১৭)।
এখন আমরা জানবো পবিত্র কোরআনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি-
* ৬১০ খ্রিস্টাব্দ ও রমজান মাসের কদরের রজনীতে হেরা পর্বতের গুহায় সর্বপ্রথম কোরআন অবতীর্ণ হয়।
* অবতীর্ণের মোট সময়কাল ২২ বছর পাঁচ মাস ১৪ দিন।
* প্রথম নাজিলকৃত পূর্ণ সূরা হলো সূরা ফাতিহা।
* সর্বপ্রথম নাজিলকৃত কোরআনের আয়াত হলো সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত।
* কোরআনের প্রথম শব্দ হলো ‘ইকরা’—তুমি পড়ো।
* কোরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত সূরা হলো সূরা আন-নসর এবং সর্বশেষ নাজিলকৃত আয়াত হলো সূরা বাকারার ২৮১ নম্বর আয়াত।
* কোরআন নাজিল শেষ হয় হিজরি ১১ সালের সফর মাসে।
* কোরআনের সর্ববৃহৎ সূরা হলো সূরা বাকারা। এর আয়াত সংখ্যা ২৮৬।
* কোরআনের সবচেয়ে ছোট সূরা হলো সূরা কাওসার। এর আয়াত সংখ্যা ৩।
* পবিত্র কোরআনের মোট সূরা ১১৪টি। এর মধ্যে মাক্কি সূরা (হিজরতের আগে বর্ণিত) ৯২টি, মাদানি সূরা (হিজরতের পরে বর্ণিত) ২২টি।
* কোরআনে মোট ৫৪০টি রুকু আছে।
* প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী কোরআনের মোট আয়াত ছয় হাজার ৬৬৬টি। কিন্তু গবেষকদের দৃষ্টিতে মোট ছয় হাজার ২৩৬টি।
* কোরআনের আয়াতের ধরন— আদেশসূচক আয়াত এক হাজার, নিষেধসূচক এক হাজার, সুসংবাদসূচক এক হাজার, ভীতি প্রদর্শনসূচক এক হাজার, কাহিনীমূলক এক হাজার, দৃষ্টান্তমূলক এক হাজার, হালালসংক্রান্ত ২৫০, হারামসংক্রান্ত ২৫০, দোয়া, জিকির ও তাসবিহসংক্রান্ত ১০০টি।
* কোরআনের মোট শব্দ ৮৬ হাজার ৪৩০টি।
* কোরআনের মোট অক্ষর তিন লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৩টি, মতান্তরে তিন লাখ ৪৯ হাজার ৩৭০টি, মতান্তরে তিন লাখ ৫১ হাজার ২৫২টি।
* কোরআনের মোট মনজিল সাতটি এবং পারা ৩০টি।
* কোরআনের মোট হরকত— জের ৩৯ হাজার ৫৮২, জবর ৫২ হাজার ২৩৪, পেশ হলো আট হাজার ৮০৪, জজম এক হাজার ৭৭১, নুকতা এক লাখ পাঁচ হাজার ৬৮১, তাশদিদ এক হাজার ৪৫৩, ওয়াকফ্ ১০ হাজার ৫৬৪, মাদ এক হাজার ১৭১ ও আলিফ মামদুদাহ ২৪০টি।
* কোরআনে হরফের সংখ্যা— আলিফ ৪৮ হাজার ৪৭৬ বা ১১ হাজার ৪৪২, তা ১০ হাজার ১৯৯, ছা এক হাজার ২৭৬, জিম তিন হাজার ২৭৩, হা তিন হাজার ৯৭৩, খা দুই হাজার ৪৪৬, দাল পাঁচ হাজার ৬৪২, জাল চার হাজার ৬৭৭, রা ১১ হাজার ৭৯৩, জা এক হাজার ৫৯৩, সিন এক হাজার ৮৯১, শিন দুই হাজার ২৫৩, ছোয়াদ দুই হাজার ১৩, দোয়াদ এক হাজার ৬০৭, তোয়া এক হাজার ২৭৭, জোয়া ৮৪২, আইন ৯ হাজার ২২০, গাইন দুই হাজার ১০৮, ফা আট হাজার ৪৯৯, ক্বাফ ছয় হাজার ৮১৩, কাফ ৯ হাজার ৫০২, লাম ৩৩ হাজার ৪৩২, মিম ২৬ হাজার ৫৬০, নুন ৪৫ হাজার ১৯০, ওয়াও ২৫ হাজার ৫৩৬, হা ১৯ হাজার ৭০, লাম আলিফ চার হাজার ৭২০, ইয়া ৪৫ হাজার ৯১৯টি।
* সর্বপ্রথম কোরআনে নুকতা ও হরকত প্রবর্তন করেন আবুল আসওয়াদ দুয়াইলি, মতান্তরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।
* হানাফি মাজহাব মতে, কোরআনে তেলাওয়াতে সিজদা ১৪টি এবং সাকতার সংখ্যা চারটি।
* কোরআনে নবী ও রাসূলের নাম এসেছে ২৫ জনের। ফেরেশতার নাম এসেছে চারজনের। শয়তান শব্দটি এসেছে ৮৫ বার, ইবলিস এসেছে ১১ বার। জিনজাতির প্রসঙ্গ এসেছে ৩২ বার।
* নবীদের মধ্যে পবিত্র কোরআনে সবচেয়ে বেশি এসেছে মুসা (আ.)- এর নাম। তার নাম এসেছে ১৩৫ বার।
* কোরআনে ছয়জন কাফিরের নাম আছে।
* কোরআনে বিসমিল্লাহ নেই সূরা তওবায়।
* কোরআনে বিসমিল্লাহ দুইবার এসেছে সূরা নামলে।
* কোরআনে বর্ণিত একজন সাহাবি হজরত জায়েদ (রা.)।
* কোরআনে বর্ণিত একজন নারী মারইয়াম বিনতে ইমরান।
* কোরআনের প্রথম ওহী লেখক জায়েদ বিন সাবেত (রা.)।
* কোরআনের মুখপাত্র হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস।
* কোরআনকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে।
* কোরআনের প্রথম সংকলক হজরত ওসমান (রা.)।
* কোরআনের প্রথম ও প্রধান তাফসিরবিদ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)।
সূত্র: রাসূল (সা.) এর যুগের বিরল ঘটনাবলী