করোনায় সিলেটে কেবলই শূন্যতা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২০, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
মহামারি করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত সিলেট। জীবনযাত্রায়ও হয়ে পড়েছে ছন্দহীন। ঘুরে দাঁড়ানোর অবিরাম লড়াইয়ে ক্লান্ত মানুষ। এরপরও করোনা লড়াইয়ে কেউ জিতছেন, আবার কেউ বা হেরে বিদায় নিচ্ছেন। করোনা সিলেটের জন্য পরিণত হয়েছে বিষাদে। চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন প্রিয়জনেরা। তাদের বিদায় জানাতেও কষ্ট হচ্ছে সিলেটের মানুষের। এরপরও একেক করে চলে যাচ্ছেন তারা।
করোনায় শূন্যতা বিরাজ করছে। প্রিয়জনদের হারিয়ে শোকাহত সবাই। প্রশ্ন সবার- কবে যাবে মহামারি, কবে থামবে মৃত্যুর মিছিল। এপ্রিলের প্রথম দিকেই সিলেটে শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল। এই মিছিল এখনো থামবে না। গতকাল পর্যন্ত ৮৪ জনে গিয়ে পৌঁছেছে। এই মৃত্যুর মিছিলে শরিক হলেন সিলেটের প্রিয় নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, এমএ হক, চিকিৎসক গোপাল শঙ্কর দে ও ডা. মঈন উদ্দিন।
প্রথমেই ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল সিলেটবাসীকে। একটি মৃত্যু সিলেটের মানুষকে কাঁদিয়ে যায় নীরবে। ১৫ই এপ্রিল মারা যান মঈন উদ্দিন। করোনাকালীন সময়ে রোগী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। যখন সব ডাক্তাররা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন ডা. মঈন উদ্দিন কর্মস্থল ওসমানী হাসপাতালে রোগীর সেবায় ব্যস্থ ছিলেন। এই মৃত্যুর পর সতর্ক হয় সিলেটের মানুষ। করোনা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্রই। ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতে মারা গেলেন করোনা আইসোলেশন সেন্টার শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের সিনিয়র ব্রাদার রুহুল আমীন। তার মৃত্যুও সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগে নাড়া দেয়। ব্রাদার রুহুল আমীনের মৃত্যুর সময়কালে সিলেটে বেশ কয়েকজন নার্স একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে- তারা করোনার সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। এখন তারা কর্মস্থলে আবার সক্রিয় হয়েছেন। ১৫ই জুন সিলেটের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক দিন। এইদিনে সিলেটের মানুষের কাছ থেকে বিদায় নেন প্রিয় নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। করোনা আক্রান্ত হয়েই তিনি সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সিলেট পৌরসভার একাধিকবারের কমিশনার, পৌর মেয়র ও দুইবার সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। শেষ জীবনে এসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। সিলেটের সম্প্রতি নায়কও বলা হয় তাকে। ২৭শে মে আক্রান্ত হয়েছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের স্ত্রী আসমা কামরান। তখন কামরানও পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তবে- উপসর্গ ছিলো কামরানের। এ কারণে ৫ই জুন আবার তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এবার রিপোর্ট আসে পজিটিভ। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন কামরান। ভর্তি করা হয়েছিল সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে। সেখান থেকে ৭ই জুন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এয়ার এম্বুলেন্সযোগে কামরানকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সিএমএইচ-এ। ১৫ই জুন ভোররাতে সিএমইএইচ-এ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান কামরান। শোকাহত হয়ে পড়ে সিলেট। করোনার কাছে হার মানলেন প্রিয় নেতা। তার এই মৃত্যুতে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতা নেমে এসেছে।
কামরানের মৃত্যুর পর সিলেটের কোভিড চিকিৎসার দিকে নজর দেন নীতি-নির্ধারকরা। বেসরকারি দু’টি হাসপাতালেও কোভিড চিকিৎসা শুরু হয়। বেশি টাকা দিয়ে হলেও এখন বেসরকারিভাবে সেবা পাচ্ছে মানুষ। সরকারি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিধি বেড়েছে। করোনা কেড়ে নিয়েছেন সিলেটেন পরিচিত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গোপাল শঙ্কর দে’কে। তিনি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক। সিলেটের মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। চিকিৎসা সেবা দিয়ে তিনি অনেকেই হৃদয় জয় করেছেন। ডা. গোপাল শঙ্কর দে’র মৃত্যুতে নতুন করে চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে তিনি মারা যান। মহামারি করোনার কাছে হেরে গেলেন তিনি। ডা. গোপাল শঙ্কর দে সিলেটের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা। সর্বশেষ গত শুক্রবার করোনার কাছে হেরে বিদায় নিলেন সিলেটের রাজনীতির আরেক প্রিয় নেতা এমএ হক। তিনি ছিলেন বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। এছাড়া বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ নেতার মৃত্যুতে কাঁদছে সিলেটের মানুষ। কামরানের মতো করোনা আক্রান্ত হয়েই তিনি বিদায় নিলেন। তবে- মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত জানা যায়নি তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুর পর নমুনা রিপোর্টে আসে তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। নগরীর যতরপুরে নিজ বাসাতেই ছিলেন এমএ হক। মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ভর্তি করা হয় নগরীর নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বুধবার রাতে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। শুক্রবার সকালে তিনি মারা যান। তার জানাজায় সিলেটের সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি’র পরিবারে নেমেছে শোকের ছায়া।
সিলেটের আরেক প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আবু নসরও ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। তিনি বর্তমানে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে নানা রোগের কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনা পরীক্ষার জন্য তারও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আবু নসর বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য। দীর্ঘদিন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনার সঙ্গে লড়াই করে আইসিইউতে গিয়েও সুস্থ হয়ে উঠছেন সিলেট জেলা বারের সভাপতি ও বিএনপি নেতা এডভোকেট এটিএম ফয়েজ এবং সিলেটের প্যানেল মেয়র এডভোকেট রোকশানা বেগম শাহনাজ। ডাক্তাররা জানিয়েছেন- তারা আগের চেয়ে অনেক সুস্থ।