ব্রিটেনে যেভাবে বর্ষসেরা ডাক্তার হলেন সিলেটী মেয়ে ফারজানা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২০, ৮:৩৬ অপরাহ্ণ
প্রবাস ডেস্ক:
করোনার এই মহামারির সময়ে সামনের সারিতে থেকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সিলেটী ফারজানা হোসেইন। সম্প্রতি দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) তাকে যুক্তরাজ্যের বর্ষসেরা চিকিৎসক ঘোষণা করেছে।
পূর্ব লন্ডনের নিউহ্যামে বসবাসকারী বাংলাদেশের সিলেটের মেয়ে ফারজানা গত ১৮ বছর ধরে স্থানীয় পর্যায়ে এই খেতাব পেয়ে আসছিলেন। এবার তিনি জাতীয় পর্যায়ে বর্ষসেরা চিকিৎসক মনোনীত হলেন। করোনাকালীন দুর্যোগে মৃত্যুর পরোয়া না করে তার এ গুরুত্বপূর্ণ অবদানেরই স্বীকৃতি দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার।
রোববার এনএইসএস-এর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান সামনে রেখেই নিজেদের ১২ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে বিলবোর্ড বানিয়েছে ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যবিভাগ। কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ সেখানে অন্যদের সঙ্গে স্থান করে নিয়েছেন ফারজানা।
এনএইচএস’র ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, এবারের বর্ষপূর্তি সংস্থাটি ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করছে। কিংবদন্তি ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার র্যানকিনকে দিয়ে ১২ চিকিৎসকের ছবি তোলানো হয়েছে। সেই ছবি দেশটির বিভিন্ন স্টপেজ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড আকারে ঝোলানো হয়েছে।
টুইটারে এনএইচএস’র পক্ষ থেকে পোস্ট করা ছবিতে দেখা গেছে, বিলবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ফারজানা। ব্রিটেনের সাটারস্টক ডটকম ছবিটি প্রকাশ করেছে।
এনএইচএস’র ওয়েবসাইটে ১২ জন চিকিৎসকের সঙ্গে ফারজানা নিজের ‘লড়াইয়ের ইতিহাস’ এভাবেই তুলে ধরেন, ১৯ বছর বয়সে আমার মা হার্টফেল করেন। ওই সময় মেডিকেল স্কুলে আমার প্রথম টার্ম ছিল। আমি মাকে দেখতে ২৫৯ মাইল পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে যেতাম।
তিনি লেখেন, বুঝতাম না মেডিকেলে ফেরা হবে কি না। কিন্তু মা বলতেন, তোমাকে যেতেই হবে। তোমাকে আমি ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাই। মা পাঁচদিন পর মারা যান।
ফারজানা লেখেন, প্রায় দুই দশক পর নিজেকে যে কতটা সৌভাগ্যবতী মনে হয়, তা বলে বোঝাতে পারবো না। রোগীদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, তারাও কোনো পরিবারের।
ফারজানা গত নভেম্বরে ২০১৯ সালে ব্রিটেনের বর্ষসেরা জেনারেল প্রাকটিশনার (জিপি) পুরস্কার পান। পালস নামের একটি সংগঠন ‘প্রতিবন্ধকতা জয় করে’ চিকিৎসাখাতে অবদান হিসেবে এ পুরস্কার দেয়। এটি ব্রিটেনের একটি সম্মানজনক পুরস্কার।
ফারজানা পুরস্কারটি পেয়েছেন নিউহ্যামের প্রজেক্ট সার্জারিতে অবদান রাখার জন্য। এই প্রজেক্টে তার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন ড. পিটার জনস। সিনিয়র এই ট্রেইনার হঠাৎ করে আত্মহত্যা করেন। তখন ভেঙে পড়েন ফারজানা।
মায়ের মৃত্যুর পর এ ঘটনা ফারজানার জীবনের দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পিটার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। ওনি চলে যাওয়ার পর ভেঙে পড়ি। আমি তার কারণেই আজকে ডাক্তার হতে পেরেছি।
এদিকে সিনিয়রের মৃত্যুর পর ফারজানা প্রজেক্টের সব সামলাতে শুরু করেন। তার প্রজেক্টের রোগীরা ব্রিটেনের অন্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে ফারজানা বলেন, মানুষের সেবা করছি এটাই বড় কথা। মহামারির সময়ে কাজে যেতে পারি শুধু একটা কথাই ভেবে-যারা বেডে পড়ে আছেন, তাদের ভালো লাগাতে হবে।
ফারজানার বাবা ১৯৭০ সালে এদেশ থেকে সেখানে পাড়ি জমান। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামনের কাতারে থেকে কাজ করেছেন তিনি। গত কয়েকমাস ধরে অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার পাশাপাশি তিনি টিকা দেয়ার ক্লিনিকগুলোতে ঘুরে ঘুরে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন।
ফারজানা এবং তার টিম করোনা মহামারিতে ব্রিটেনের রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। গত তিন বছরে নিউহ্যামের স্থানীয় চিকিৎসা কমিটিতে ছিলেন। ফারজানা নিউহ্যামের জেনারেল প্র্যাকটিস ফেডারেশনের বোর্ড ডিরেক্টরের দায়িত্বও পালন করে আসছেন। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের এনএপিসির কাউন্সিল সদস্য তিনি।
ফারজানা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইমারি কেয়ারের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, অর্থনৈতিক সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করাই তার লক্ষ্য।